আলোর মিছিলে হাওরের মেহনতি কৃষক

April 30, 2020

মাছের সময়ে ভালো মাছ না পেলে বৈশাখের মুখ চেয়ে থাকা, এদিকে যদি বানের জলে ফসল ভেসে যায়, তো আবার মাছের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা। গত বছর হাওরে ভালো মাছ পাওয়া যায়নি। হাওরের মানুষ দেখেছে, কয়েক বছর ধরে মাছ কমই আসছে। কিন্তু এবারের বৈশাখে কৃষক যা দেখলো, তা বোধ করি ১০০ বছরেও দেখা যায়নি।

করোনার ক্রান্তিকালে, অপেক্ষার হাল ধরেছে কৃষক। এই বৈশাখে ধানে সোনা রং ধরতেই তারা  আর ঘরে বসে থাকেননি। থাকবেন কী করে ? অদৃশ্য অনুজীবের বিরুদ্ধে এ যে মানুষের সম্মুখ সমর! এ যুদ্ধে হেরে গেলে হয়তো দেশে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। কৃষক কী তা হতে দিতে পারে? আমাদের কৃষকের যে বড়ো মায়ার শরীর!

সোনালি রঙের ছোঁয়া লেগেছে হাওরের পাকা ধানে।  তাই ছোঁয়াচে রোগের ভয় কাটিয়ে কাস্তে হাতে মাথাল মাথায় কৃষক নেমেছে মাঠে। হাওরে এখন ভরা বৈশাখ। এখনই তো ধান কেটে তুলতে হবে। নইলে আবার কখন বাঁধভাঙা জল এসে ভাসিয়ে দেয় কৃষকের সোনা ধান! তাই হাওরের বুঝি ব্যস্ততা এবার একটু বেশিই। হবে না-ই বা কেন? সারাদেশের বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রার ২০ ভাগের জোগান দেয় হাওরের বোরোচাষ।

বছরের অর্ধেক সময় জলে ডুবে থাকা হাওর এলাকার মানুষ মাছধরা ছাড়া এই ধানের কাজটুকুই কেবল করার সুযোগ পায়। কেউ নিজের জমিতে ধান করে, আর জমি না থাকলে অনেকে বর্গা নেয়। আবার কেউ বা অন্যের জমিতে শ্রম খেটে বৈশাখে কিছু টাকা আয় করে নেয়। কিন্তু হাওরের পরিবেশের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রও দিনদিন বদলাচ্ছে। একসময় পরিবারের ময়মুরুব্বীরা আকাশের হালচাল দেখে দিনের আবহাওয়া বুঝে নিতেন। ঢেউয়ের মাপ গুণে বুঝে নিতেন হাওরের মাছের চলার বাঁক। বাতাসের গন্ধে টের পেতেন আফালের গতি। (আফাল-হাওরের ঝড়)

এখন দিন বদলে গেছে। সবসময় আর ভালো মাছ পাওয়া যায় না। আবার বড়ো বড়ো জলমহালের মালিকদের কারণে সব জায়গায় মাছও ধরা যায় না। আরও আছে অগ্রিম টাকা নিয়ে শ্রম আর মাছ বিকিয়ে দেওয়ার রীতিনীতি। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো, হাওরে মাছ ধরতে গেলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। মৌসুমি শ্রমখাটা জাল ও জলের মানুষগুলোর জীবন যেন বছরের আধাআধি হিস্যায় ভাগ হয়ে গেছে।

মাছের সময়ে ভালো মাছ না পেলে বৈশাখের মুখ চেয়ে থাকা, এদিকে যদি বানের জলে ফসল ভেসে যায়, তো আবার মাছের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা। গতবছর হাওরে ভালো মাছ পাওয়া যায়নি। হাওরের মানুষ দেখেছে, কয়েক বছর ধরে মাছ কমই আসছে। কিন্তু এবারের বৈশাখে কৃষক যা দেখলো, তা বোধকরি ১০০ বছরেও দেখা যায়নি।

হঠাৎ করোনা নামের শ্বাসতন্ত্রের এক ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে এদেশে। কারও তিনফুটের মধ্যে এলেই রোগটি ছড়াতে পারে। ফলে হাওরের মানুষের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে একাধিক জেলা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। জেলা থেকে জেলায় শ্রমিকের যাতায়াত নিষেধ। প্রতিবছর কত কত মানুষ দূরদুরান্ত থেকে এসে হাওরের ধান কেটে দেয়। এবার কী হবে? একে অন্যের কাছ থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু বৈশাখ হলো কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে ধানকাটা আর গলা ছেড়ে গান গাওয়ার মৌসুম, তবে উপায় কী?

শুধু বাংলাদেশ নয়, এই বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ব্যহত ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনকী কোনো কোনো দেশে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও ‍কৃষি সংস্থা (FAO) । যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। তাই এমন সময়ে, কৃষি উৎপাদনের ধারা সচল থাকা চাই। ফসল ফলানো চাই প্রতিটি ইঞ্চিতে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এবছর শুধু হাওরের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট আউশ, আমন ও বোরো মিলে প্রায় তিন কোটি ৮৭ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগই পূরণ করবে বোরো ধান।

সময়মতো এই ধান কাটতে হবে, নইলে বন্যার পানিতে ভেসে যেতে পারে ২০১৭ সালের মতো। এদিকে ধানের জমিতে মানুষ এক সারিতেই ধান কাটতে থাকে। ফলে একজন আরেক জনের ‍খুব কাছে চলে আসে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ থাকে না। তাছাড়া মাঠে বা থাকার জায়গায় ঘনঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোওয়ার সুযোগ নেই। রোদের মধ্যে কাজ করা লাগে।  বারবার গামছায় মুখ, হাত মোছা লাগে। এই আচরণগুলো করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

মানুষের পাশে আছে ব্র্যাক। সুতরাং, হাওরেও এর ব্যত্যয় নেই। ব্র্যাক সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি (আইডিপি) ২০১২ সাল থেকে হাওর জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, ও হবিগঞ্জের পাঁচটি উপজেলার অতিদরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছে। করোনাক্রান্তিকালে আইডিপি হাওরের সাড়ে চার লক্ষাধিক মানুষের কাছে করোনাভাইরাস বিষয়ক সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকগান শিল্পী কুদ্দুস বয়াতির সচেতনতামূলক গান বাজিয়ে কমিউনিটির মানুষকে শুনিয়েছে প্রতিটি উপজেলায়। তাছাড়াও প্রাথমিকভাবে ব্র্যাক আইডিপি হাওরের সতেরো হাজার পরিবারকে খাদ্য নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রদান করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় হাওরে বোরোধান কাটতে আসা শ্রমিকদের জন্য গ্রহণ করেছে বিশেষ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন।

ব্র্যাক আইডিপির উদ্যোগে বোরো ধান কাটতে আসা মানুষের উদ্দেশ্যে তাদের প্রিয় ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, খ্যাতনামা কৃষি-সাংবাদিক, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জনাব শাইখ সিরাজের উপস্থাপনায় একটি ভিডিওবার্তা নির্মাণ করা হয়। সেখানে তিনি কৃষকদের নিরাপদে ধান কাটার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, নাকে মুখে চোখে বার বার হাত না দেয়া, অন্যের গামছা ব্যবহার না করা, ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে দুই হাত ভালোভাবে ধোয়া ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দেন। সামাজিক গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে। সাইকেল রিকশা ও ভ্যান ব্যবহার করে বর্তমানে হাওরের মাঠে মাঠে বিশেষ বার্তাটির অডিও ভার্সন বাজিয়ে শোনানো হচ্ছে। যাতে করে কৃষকেরা ধান কাটতে কাটতেই শুনে নিতে পারেন সুস্থ থাকার নিয়মগুলো।

শুধু তাই নয়, কমিউনিটি রেডিও পল্লীকণ্ঠ এফএম ৯৯.২ সহ ১৬টি কমিউনিটি রেডিওতেও এই বিশেষ অডিওটি সম্প্রচার করা হবে। পাশাপাশি কৃষকের থাকার জায়গায়, মাঠের আশেপাশে ১৫৫টি স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলে ভিডিওটি নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে।  অর্থাৎ ‍তৃণমূলের মানুষের কাছে সবচেয়ে সহজতম পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবনরক্ষাকারী তথ্য পৌঁছে দেওয়ার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক।

বাংলার কৃষককে মে দিবসে হৃদয়ের গভীর থেকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মহামারিকে জয় করতে ব্যক্তিগত সচেতনতার নিয়মগুলো মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হাতে কাস্তে তুলে নিয়েছেন তারা। কৃতজ্ঞতা শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি, স্বেচ্ছাসেবী মানুষদের প্রতি, যারা মাঠে নেমেছেন হাওরের কৃষকের ধান কেটে দিতে। ভালো মানুষের আলোর মিছিলে আপনাদের স্বাগত জানাই।

 

খালেদা আক্তার লাবনী, ম্যানেজার, কমিউনিকেশন অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট,  সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি (আইডিপি), ব্র্যাক।

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা এবং সুহৃদ স্বাগত

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shaira Siddika
Shaira Siddika
3 years ago

Well writte.

Observer
Observer
3 years ago

ভালো মানুষরাই একমাত্র ভালো কাজের পাশে থাকে। ধন্যবাদ।

Maksudur Rahman
Maksudur Rahman
3 years ago

এইসব কৃষকদের কথা কেউ ভাবে না, ধন্যবাদ ব্র্যাক সুন্দর উদ্যোগের জন্য।