স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

December 15, 2022

তখনও বিশ্বায়নের হাওয়া এদেশে সেভাবে লাগতে শুরু করেনি। এত দোকানপাটও ছিল না। কিন্তু ছিল ফেরিওয়ালারা। তপ্ত দুপুরে, কিংবা কুয়াশার চাদর মোড়ানো বিকেলে জানালা দিয়ে ভেসে আসত তাদের ডাক।

তপ্ত দুপুরে, কিংবা কুয়াশার চাদর মোড়ানো বিকেলে জানালা দিয়ে ভেসে আসে ফেরিওয়ালার ডাক। কেউ শনপাপড়ি, জলপাইয়ের আচার, কেউ হাঁড়িপাতিল, কেউবা আবার শাড়ি, থ্রি পিছ ফেরি করে যাওয়ার সময় জানান দেয় নিজের উপস্থিতি। পুরোনো জিনিসপত্র কিংবা টাকা দিয়ে কেনা যায় সেগুলো। বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে আর নারীরাই সাধারণত এসব পণ্যের মূল ক্রেতা। নানা কারণে তাদের বাজারে যাওয়ার সুযোগ সেভাবে মেলে না। ওদিকে সংসারের টুকিটাকি কেনাকাটাও তো প্রয়োজন। ফেরিওয়ালা যদি বাড়ি এসে বিক্রি করে যায় তাহলে তো আর কথাই নেই।

নব্বইয়ের দশকে যাদের জন্ম, তাদের কাছে খুবই সাধারণ এ ব্যাপারটি। তখনও বিশ্বায়নের হাওয়া এদেশে সেভাবে লাগতে শুরু করেনি। এত দোকানপাটও ছিল না। কিন্তু ছিল ফেরিওয়ালারা। গ্রাম কিংবা শহর সবখানেই দেখা মিলতো তাদের। ঢাকার বাউনিয়াবাদের তাসলিমা বেগমও ছিলেন এমনই একজন। সেই সকালবেলা মাথায় কাপড়ের গাট্টি নিয়ে বের হতেন। এ মহল্লা, সে মহল্লা ঘুরে পশ্চিমাকাশে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়লে তবেই না ঘরে ফিরতেন তিনি।

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা। স্বামী-সন্তান নিয়ে তাসলিমা বেগম তখন ঢাকায় ছিলেন অনেকটা ভাসমান অবস্থায়। থাকার জন্য নিজের কোনো ঘর ছিল না। সরকারি জায়গায় একটা ছোট্ট টিনশেড ঘর তুলে কোনোমতে পরিবারের সবাই মিলে থাকতেন।

তাসলিমা বেগমের স্বামী দিনমজুরি করে যে টাকা আয় করতেন তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানো ভার। আর যেদিন কাজ জুটে না, সেদিন তো তাদের সবাইকে না খেয়েই থাকতে হতো। ক্ষুধার তাড়নায় বাচ্চাদের চিৎকার তাসলিমার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। অভুক্ত ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারে সচ্ছলতা আনতে তিনি ফেরি করে কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করেন।

খুব সকালবেলা রান্নাবান্না সেরে মাথায় কাপড়ের গাট্টি উঠিয়ে বের হতেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হাঁক ডেকে সুরে সুরে বলতেন- কাপড় লাগবে… কাপড়… মেয়েদের শাড়ি, থ্রি পিছ, বাচ্চাদের গেঞ্জি-প্যান্ট আছে… কাপড় লাগবে… কাপড়…।

গৃহিণীরা জানালা কিংবা বারান্দা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ডেকে এনে তাসলিমার কাপড়ের গাট্টি খুলে দেখতেন। পছন্দ হলে কিনতেন এটা-ওটা। কেউ আবার পরের সপ্তাহে আসার সময় তার জন্য কী আনতে হবে বলে দিতেন। তিনি পরবর্তীতে যখন ঐ এলাকায় গেলে মনে করে সেসব জিনিস নিয়ে যেতেন। এভাবে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতে করতে একসময় তাসলিমার কিছু নিয়মিত ক্রেতা জুটে যায়।

বছর কয়েকের মধ্যেই ব্যাবসাটা ভালোমতো বুঝতে শুরু করেন তিনি। আয়রোজগার ভালো হওয়ায় তাসলিমা সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে রাতে বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবতেন- এবার একটা দোকান নিলে কেমন হয়!

তার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। দোকান ভাড়া, মালামাল কেনার জন্য আরো কিছু টাকার প্রয়োজন। আত্মীয়স্বজন কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী তেমন কেউ নেই যে তাকে কিছু টাকা ধার দিয়ে সহায়তা করবে। তাসলিমা তাই কোথায় কম সুদে ঋণ পাওয়া যায় সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। একপর্যায়ে ব্র্যাকের পল্লবী শাখা অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হয় তার। তিনি তাকে জানান, ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ব্র্যাকের ‘প্রগতি’ ঋণ দেওয়া হয়।

তাসলিমা এ সুযোগটা কাজে লাগান। প্রথমবার তিনি ৮০ হাজার টাকা ঋণ নেন। বাউনিয়াবাদেই ছোট্ট একটা দোকান নিয়ে শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। সারাদিন কাপড় নিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে বেড়ানোর ঝক্কিঝামেলা থেকে মুক্তি মেলে তার।

ফেরি করে কাপড় বিক্রির সময় যারা তার কাছ থেকে নিয়মিত কিনতেন, তাদের প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে তাসলিমা তার দোকানের ঠিকানা জানিয়ে আসেন। কম দামে ভালো কাপড় বিক্রি করায় অল্পদিনের মধ্যেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাসলিমা আগের চেয়ে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

একা হাতে দোকান সামলাতে থাকেন তিনি। মাঝে মাঝে বিনিয়োগের জন্য ব্র্যাক থেকে ঋণ নিতেন, আবার সময়মতো তা পরিশোধও করতেন। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে জায়গা কিনে থাকার জন্যে একটা বাড়িও করে ফেলেন তিনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দিকেও সমান নজর ছিল তার। তাদেরকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।

দিনমজুর স্বামীর প্রতিদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি তাসলিমাকে অনেক পীড়া দিত। তাই তিনি তাকে উৎসাহ দেন ড্রাইভিং শিখতে। তার স্বামী ড্রাইভিং শিখে পিকআপ ভ্যান চালিয়ে আগের থাকে ভালো রোজগার করতে থাকে।

তার বড়ো ছেলে এখন সৌদি আরব থাকে। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। আর ছোটো ছেলে একটা গ্যাস পাম্পে চাকরি করার পাশাপাশি মায়ের কাজে সহায়তা করে। তাসলিমা বেগম তার দুই ছেলেরই বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটাও তার স্বামীর সংসারে ভালোই আছে।

কিছুদিন আগে ব্র্যাকের একজন কর্মীর কাছ থেকে তিনি আগামী অ্যাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। এখন অ্যাপ ব্যবহার করে ঘরে বসেই ঋণ ও জমার পরিমাণ দেখা যাবে। তার জন্য হিসাব রাখা এখন আরও সহজ হয়ে গেল।

বাউনিয়াবাদে সবাই তাসলিমা বেগমকে এখন এক নামে চেনে। সেখানে তিনি কারো কাছে আদরের বুনু, কারো কাছে চাচি আবার কারো কাছে খালা। ফেরি করে তিনি যে স্বপ্নের পেছনে ছুটতেন তা আজ তার সাহস, পরিশ্রম, আর দক্ষতার বলে পূর্ণতা পেয়েছে।

সম্প্রতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য পরিচালিত প্রগতি ঋণ এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। তাসলিমার মতো কখনই যারা আশা ছাড়েননি, স্বপ্ন দেখা থামাননি-এমন দশ লক্ষ মানুষ এখন আমাদের প্রগতি পরিবারের সদস্য, আমাদের অনুপ্রেরণা। এই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা অসাধারণ ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যতে। দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা এগিয়ে যাক সাফল্যের পথে। ব্র‍্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স পাশে আছে ও থাকবে যেকোনো প্রয়োজনে।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
গল্প সংগ্রহে- সুহৃদ স্বাগত

3.8 6 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments