স্বপ্নের ডালপালায় ফুটেছে সাফল্যের ফুল

September 22, 2022

“আমার এখানে এক মেয়ে আসতো চারা কিনতে। এখন তিনিও আমাকে অনুসরণ করে নিজে নার্সারি দিয়েছেন। ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে যে, আমি কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি।” – নুরজাহান বেগম

আমাদের সমাজের একটি প্রচলিত ধারণা এই যে, অবসরে যাওয়া মানেই ফুরিয়ে গেল সব। একটা সময় ছিল যখন একবার চাকরি ছেড়ে দিলে বা অবসরে গেলে আবার নতুন করে কোনো কিছু শুরু করা যায়, এমনটা ভাবতেই পারতেন না কেউ। অথচ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, ফলে বয়স্ক কর্মক্ষম লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। এটা হতে পারে নতুন এক অধ্যায়, সম্ভাবনার শুরু- নুরজাহান বেগমের নার্সারি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

“আমি চাকরি ছেড়েছিলাম ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ। ১৫ তারিখ বাড়িতে নার্সারি করলাম। মূলত নার্সারির কাজটা শুরু করি শখের বশে। ছোটোবেলা থেকেই গাছপালা, পশুপাখির প্রতি আলাদা টান ছিল। আর এখন তো ১২ বছর ধরে নার্সারির কাজের সাথেই যুক্ত আছি। আমার এখানে অনেক রকমের ফল ও ফুল গাছ আছে। কোনো বিদেশি ফলের গাছ পেলেই আমি তা সংগ্রহ করি। এই ধরুন বিদেশি আম, থাই আমড়া অথবা নানা রকম ফুলের চারা।”- নুরজাহান বেগম।

আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আধুনিক শহরের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, গম্ভীর কালো পিচ, তকতকে রাস্তা। নতুন নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে আধুনিক ধ্যানধারণার সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রা। সেইসাথে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কাজ করার ক্ষেত্র। নতুন ধরনের এসব কাজের ক্ষেত্রে তরুণদের পাশাপাশি চাইলে যুক্ত হতে পারেন বয়স্ক ব্যক্তিরাও। এতে বয়স্ক ব্যক্তিদের মন ও শরীর দুইই ভালো থাকবে, আবার আয়রোজগারও বাড়বে।

নিজের ভালোলাগাকে তুলে ধরতে গিয়ে নুরজাহান বেগম বলেন, “আমার এখানে এক মেয়ে আসতো চারা কিনতে। এখন তিনিও আমাকে অনুসরণ করে নিজে নার্সারি দিয়েছেন। ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে যে, আমি কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি।”

নুরজাহান বেগম ২০০০ সালে কিশোরগঞ্জে ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্সের সাথে পথচলা শুরু করেন। শুরুতে তিনিই গ্রামে গ্রামে গিয়ে সবাইকে কর্মসূচির কার্যক্রম সম্পর্কে জানিয়েছেন। ২০০২ থেকে ২০১০, ব্র্যাকের হাত ধরেই ছিলেন। এরপর একসময় নুরজাহান বেগম মনে করলেন, এবার চাকরি জীবনে খানিক বিরতির প্রয়োজন। ব্র্যাক ছেড়ে দিলেন তিনি।

চাকরি ছাড়লেও এতদিনের অভিজ্ঞতাকে ভুলে গেলেন না তিনি। ব্র্যাকে এগ্রিকালচার ও নার্সারি নিয়ে কাজ করতেন নুরজাহান বেগম, নিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ। সবজি চাষ ও গাছ পরিচর্যার বিষয়ে ভালো করে জানার সুযোগটা সেখানেই হয়েছিল।

চাকরি ছাড়ার পর তিনি শখকেই পেশা হিসেবে নিলেন, বাড়িতে নার্সারি দিলেন। নিজের নার্সারির উৎপাদিত ফুল, ফল, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা বিক্রি শুরু করলেন। আজ এর আয় থেকেই তিনি ২৮ শতক জমি রেজিস্ট্রি করেছেন। এখন আরও দুজনকে তিনি নার্সারির কাজে নিয়োগ দিয়েছেন। নার্সারি কেবল নুরজাহান বেগমের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এনেছে তা নয়, তিনি তার সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে লাভ করেছেন সফল নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার।

এবছর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় ৩ দিন ব্যাপী কৃষি মেলা-২০২২ এর উদ্বোধন হয়েছে। প্রতিবারের মতো তিনি এবারও স্টল দিয়েছেন এই মেলায়।

শেষ করছি নুরজাহান বেগমের একটি স্বপ্নের কথা দিয়ে। নিজের জীবনে উন্নতির পাশাপাশি তার ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে চান আরও অনেকের মাঝে। দেশের মানুষের জন্য আরও কিছু করার ইচ্ছে আছে তার। তিনি বলেন, “আমি যখন ব্র্যাকে কাজ করতাম, তখন দেখেছি বয়স্ক মানুষ কীভাবে কষ্ট পাচ্ছে। আমার একটা স্বপ্ন আছে, আমি একটা বৃদ্ধাশ্রম দিতে চাই। যারা বৃদ্ধ বয়সে অবহেলিত, তাদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা আছে। জানি না সফল হতে পারব কি না, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

 

সম্পাদনা- রুবাইয়া আক্তার দিনা, তাজনীন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments