সেলাই মেশিনে স্বপ্ন বুনন

November 12, 2020

তিনি তার এই লাভজনক উদ্যোগের সাথে গ্রামের অন্য মেয়েদেরও এখন যুক্ত করতে চান। অনেকে নিজে দোকান দেবার জন্য তার কাছে কাজ শিখতে আসে। আবার কেউ কেউ ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ করবে-এই আশায় সেলাইয়ের কাজ শিখতে আসে।

‘আমার জীবনে তো যা হবার হয়েছে, কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে কোনো দুঃখ দেখতে চাই না। যা কষ্ট করার আমি করেছি, ওর যেন আর কোনো কষ্ট করতে না হয়। মেয়েটা যেন তার নিজের মতো করে জীবন গড়ার কথা ভাবতে পারে, এটুকু সম্পদ ওর জন্য রেখে যেতে চাই।’

সাবিনা একজন আত্মবিশ্বাসী নারী। তিনি জীবন সংগ্রামে দমে যেতে পারতেন, পারতেন মুখ বুজে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন চলতে। হয়তো এভাবেই একজন সাবিনা হয়েই হারিয়ে যেতেন, বন্দীত্ব বরণ করেই একদিন বেছে নিতেন কেবল সয়ে যাবার পথ। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন সেই পথ, যে পথে খুব কম মানুষই যান।

এখন মেয়েকে ঘিরেই তার স্বপ্ন। জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাই স্বপ্নপূরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাবিনা তাকে সবার আগে লেখাপড়া শেখাতে চান।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার ভবদগড়ি গ্রাম। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মেয়ে সাবিনা টুডু বিয়ে করেছিল গারো সম্প্রদায়ের এক ছেলেকে। বিয়ের পর চলে আসে ঢাকায়। গাজীপুরে একটি গার্মেন্টেসে চাকরি নেয়। তখনও পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।

পোশাক সেলাইয়ের কাজে কিছুদিনের মধ্যে দক্ষ হয়ে ওঠেন সাবিনা। একসময় গার্মেন্টেসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসায়ই সেলাই মেশিন কিনে দর্জিকাজ শুরু করেন। মন দিয়ে, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি শিখেছিলেন। তাই সুনাম ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। আয়রোজগারও হতে লাগল ভালোই।

কিন্তু সমস্যা বাসা বাঁধছিল অন্য জায়গায়। কারণে-অকারণে টাকা চাওয়াই স্বামীর স্বভাব, এটা এতদিনে সাবিনার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। স্ত্রীর উপার্জনেই তার লোভ, তার কষ্টের প্রতি না আছে কোনো সম্মানবোধ, না আছে কোনো কৃতজ্ঞতা। তাই সংসারে সুখ হলো না। বাড়তে লাগল অশান্তি।

টাকা না দিলে স্বামী শুরু করে নির্যাতন, অবর্ণনীয় নির্যাতন। স্ত্রীর এই এগিয়ে যাওয়া স্বামীর লোভের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। সেলাইয়ের দোকান বন্ধ করে দেবে- রোজ এমন হুমকি। একদিন সত্যিসত্যিই কলহের এক পর্যায়ে সাবিনার সেলাই মেশিনটি সে ভেঙে ফেলল। যত রাগ ওই মেশিনের ওপর।

সাবিনা দাঁতে দাঁত চেপে সব নির্যাতন সহ্য করতে থাকেন। তখন ২০০৯ সাল, কন্যা সন্তানের মা তিনি। কিন্তু স্বামীর আচরণে আসেনি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন। টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ দিনদিন বেড়েই চলছিল, সেইসঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন।

সাবিনার ব্যাংকের জমানো টাকাতেও তার নজর পড়েছে। অত্যাচারে অসহ্য হয়ে সাবিনা একদিন সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েকে নিয়ে বাধ্য হয়ে তিনি দিনাজপুরে তার নিজের গ্রামেই ফিরে যান। কিন্তু নিজ ভিটায় ফিরে গেলেও অভাব কী তার পিছু ছাড়ে? সেখানে আয়রোজগারের ভালো উপায় জুটল না।

ধানের দিনে খেতে কাজ করে আর কটা টাকাই বা আয় হয়?

আবার তিনি কাজের সন্ধানে ঢাকায় ফিরে এলেন। সাবিনা ফিরে এসেছে টের পেয়ে স্বামী আবারও তার ক্ষতি করার সর্বোচ্চ পায়তারা করতে থাকল। সাবিনার কাছে বারবার যায়, নানারকম হুমকি দেয়, বাচ্চা নিয়ে যাবে বলে ভয় দেখায়। এ নিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলে বিচার-সালিশও হয়। তারা সাবিনাকে মিলমিশ করে আবার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বলে।

সাবিনার আত্মসম্মানবোধ যেমন আছে, তেমন আছে নিঃস্ব এবং নির্যাতনের শিকার হবার ভয়। তাই এই সমাধান সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ৬ বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে এক কাপড়ে আবার সে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। স্বামী কাছে ফিরে না যাবার সিদ্ধান্তে থাকেন অনড়।

দিন পেরিয়ে যায়, অভাব অনটনে বদলায় বছর। ২০১৩ সালের কথা। ব্র্যাকের সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি (আইডিপি)-র একটি সভায় গবাদি পশু পালন সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, তাই সদস্যদের আসতে বলা হয়েছিল। সাবিনাও সভায় যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু যেতে ইতস্তত করছিলেন। তার তো কোনো গবাদি পশু নেই, সেখানে গিয়ে কী লাভ হবে?তবুও কী মনে করে তিনি গেলেন। সদস্য হিসেবে অন্যদের সঙ্গ দেওয়ার জন্যই বোধহয়। কথা প্রসঙ্গে ব্র্যাক আইডিপি কর্মসূচি সংগঠক (পিও) সেদিন উক্ত সভায় সাবিনার কষ্টের কথা জানতে পারেন। যেহেতু সাবিনার সেলাই কাজের পূর্ব  অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং একটি সেলাই মেশিনও রয়েছে কিন্তু পর্যাপ্ত আয় হতো না। তাই সাবিনা আইডিপি-র কর্মসূচি সংগঠক (পিও) কে ভিডিও মিটিংএ বলেন, “আমাকে কাপড়ের দোকান করার জন্য সহায়তা করেন তাহলে সেলাই এর পাশাপাশি কাপড় বিক্রি ও সেলাই দুটো থেকেই আমি নিয়মিত আয় করতে পারবো।” সাবিনার এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন ও তার পারিবারিক আয়বৃদ্ধির জন্য ব্র্যাক সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচির প্যাকেজ থেকে ১৫,০০০ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন। এই প্যাকেজের টাকা দিয়ে তাকে একটি ছাগল বাদবাকি ১১০০০ টাকার গজ কাপড় কিনে দেওয়া হয়।

শুরু হলো নতুন করে পথচলা! সেই গজ কাপড় দিয়ে সাবিনা এবার সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের পোশাক বানাতে শুরু করলেন। সেগুলো বিক্রির জন্য এখন তাকে থরে থরে সাজানো!

সাবিনার বাড়িতে এখন ৬টি ছাগল আছে। তিনি সঞ্চয়ে বিশ্বাস করেন। ব্যবসার লাভের টাকা জমিয়ে এবং ক্ষুদ্রঋণের টাকা দিয়ে তিনি ১২ শতক আবাদী জমি লিজ ও ১০ শতাংশ বসতভিটা ক্রয় করেছেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, নিজের সামান্য জমিও এখন আছেমাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করেন, উৎসবপার্বণে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। তাতে তার বেশ চলে যায়। মেয়েটিও এখন একটু বড়ো হয়েছে, কাজকর্ম শিখছেখুবই আন্তরিকভাবে মাকে সাহায্য করারও সে চেষ্টা করে।

জীবনে ঝড় বয়ে যাবার পর এখন এই স্বাভাবিকতা, স্বাচ্ছন্দ্যটুকু সাবিনার নিজের কাছেই স্বপ্নের মতো মনে হয়। ২০১৯ সালে তার সামর্থ্য আরও একটু বেড়েছে। সেলাই মেশিন এখন দুইটি। আরও একটি বড়ো বিষয় হলো, তার এই লাভজনক উদ্যোগের সাথে তিনি গ্রামের অন্য মেয়েদেরও এখন যুক্ত করতে চান। অনেকে নিজে দোকান দেবার জন্য তার কাছে কাজ শিখতে আসে। আবার কেউ কেউ ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ করবে-এই আশায় সেলাই কাজ শিখতে আসে।

সাবিনা গ্রামের আগ্রহী মেয়েদের সেলাই কাজ শেখাবেন বলেই দ্বিতীয় সেলাই মেশিনটি কিনেছেন। ৪৫ দিনের সেলাই শিক্ষার এই কোর্সে তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেন ৪০০০টাকা। সাবিনার কাছে হাতে-কলমে কাজ শিখে ৩ জন এখন চাকরির চেষ্টা করছে এবং ২ জন এখনও কাজ শিখছেন।

এভাবে নিজের বেছে নেওয়া পথে নিজের গতিতেই জীবনে এগিয়ে চলেছেন সাবিনা। তাকে থামাতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, তার পথে বাধা হতে পারেনি স্বামীর লোভ এবং হীনমন্যতা। এমন অনেক সাবিনা আছেন আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, গ্রামে, শহরে- যাদের কারণে অন্যরাও আজ স্বপ্ন দেখেন!

 

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments