আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, তামিম ইকবাল, মাশরাফি, সাকিবদের নাম এদেশের ক্রিকেট ভক্ত সবারই জানা। কিন্তু মোঃ মহসিনের নাম? নাহিয়ান, দেলোয়ার হোসেন, নূর মোহাম্মদ মুনশির নাম? সবার অলক্ষ্যে তারা ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন নিজেদের, বিদেশে গিয়ে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন- এনে দিচ্ছেন সাফল্য।
হুইলচেয়ার ক্রিকেট! নীরবে-নিভৃতে এগোতে থাকা এবং দেশের জন্য ইতিমধ্যেই সাফল্য বয়ে আনা এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও পারে! তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত এই উদ্যোগ, এই খেলা।
ক্রিকেট বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মোঃ রফিক, আশরাফুল, তামিম ইকবাল, মাশরাফি, সাকিবের নাম এদেশের ক্রিকেট ভক্ত সবারই জানা।
কিন্তু মোঃ মহসিনের নাম? নাহিয়ান, দেলোয়ার হোসেন, নূর মোহাম্মদ মুনশির নাম? সবার অলক্ষ্যে তারা ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন নিজেদের, বিদেশে গিয়ে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন- এনে দিচ্ছেন সাফল্য।
হ্যাঁ, তাদের হাত ধরেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল। এই যাত্রার মূল কান্ডারি হলেন মোঃ মহসিন। ক্রিকেটপাগল মহসিন ছয়মাস বয়সেই পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে সারাজীবনের জন্য হারান পা ব্যবহারের ক্ষমতা। তার জন্ম ঢাকার অদূরেই টঙ্গীতে। আমরা জানি, ক্রিকেট খেলতে শারীরিক সক্ষমতা, নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন স্বপ্ন আর মনোবল। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা মহসিনের সেই স্বপ্ন কোনো বাধ মানেনি, মনোবল অসীম।
যখন থেকে ক্রিকেট ভালোবেসে খেলতে চেয়েছেন তখন থেকেই শুনে আসছেন, ‘পা চলে না আবার ক্রিকেট খেলবে, এত সহজ!’ শুধুমাত্র ক্রিকেট ভালোবাসেন বলে মানুষের সব অবহেলা, অবজ্ঞাকে তিনি তার ইস্পাত দৃঢ় মনোবল নিয়ে সহ্য করেছেন। মাঠে মাঠে ঘুরেছেন যদি খেলার সুযোগ পান, কত মানুষের কাছে গেছেন একটু পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার আশায়- কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জুটেছে প্রত্যাখ্যান।
মহসিন থামেননি, আজ তাই তার হাত ধরেই বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে সেই হুইলচেয়ার ক্রিকেট নামের এক নতুন বিস্ময়, এক নতুন হার না মানার দৃষ্টান্ত, এক নতুন লড়াই। মনোবল এবং খেলার ইচ্ছেশক্তির পাশাপাশি তার সাংগঠিক দক্ষতাও অত্যন্ত উঁচুমাপের। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তা এবং ‘সিআরপি’-র সহযোগিতায় ২০১২ সালে গঠিত হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল। ২০১৪ সালের জুন মাসে তাজমহল ট্রফি খেলতে মহসিনের দল ভারত সফরে যায়। সেখানে তারা সিরিজ জয় করেন।
২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘হুইলচেয়ার ক্রিকেট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের আওতায় সংগঠনটি নিবন্ধিত হয়। বিভিন্ন জেলার আগ্রহী খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়ে মহসিন এবার খেলায় মনোনিবেশ করে। সেই ধারাবাহিকতায় সেবছরের অক্টোবর মাসে ৩২ জন হুইলচেয়ার ক্রিকেটার ৪টি দলে বিভক্ত হয়ে রাজধানীর হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো এক টুর্নামেন্টে অংশ নেয়।
৩২ জনে তখন শুরু, এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০-এরও বেশি এবং এই সংখ্যায় শুধু পুরুষরাই নেই, আছেন নারীরাও।
২০১৭ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জেতে মহসিনের দল, সেই বছরই আবার নেপালে অনুষ্ঠিত হয়ে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ যেখানে তারা হয় রানার-আপ। এখন পর্যন্ত ছয়টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে মহসিনরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনটিতে। এছাড়াও হুইলচেয়ার ক্রিকেটের এই সংগঠন দেশে আটটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা এবং সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণে ব্র্যাক সর্বদাই সোচ্চার। এর আগে সচেতনতামূলক কিছু কর্মকাণ্ডে মহসিন ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে ব্র্যাক। ভারতে অনুষ্ঠিতব্য বিশেষ টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাচ্ছে মহসিনের দল, আর ব্র্যাক থাকছে দলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায়।
করোনা মহামারির কারণে নিয়মিত ক্রিকেটারদের মতো গত দুবছর তারাও খেলার বাইরে ছিলেন। করোনার পর সুযোগ-অর্থ-স্পন্সর এবং টুর্নামেন্ট নিয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছিলেন মহসিন। বিশেষ করে আর্থিক এবং অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে দলের মূল খেলোয়াড়দের একত্র করতে পারছিলেন না, পাচ্ছিলেন না প্র্যাকটিসের সুবিধা।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে তার এই প্রতিকূল সময়ে ব্র্যাক এগিয়ে আসে।
হুইলচেয়ার ক্রিকেট শুধুমাত্র কয়েকজন তরুণের সীমাবদ্ধতাকে জয় করা নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক রূপান্তর। নিজেদের স্বপ্নের পথ খুঁজে পেতে, যা ভালোবাসেন তাই করে যেতে কিছু মানুষ শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে দিচ্ছেন নিজের মন উজাড় করে।
মহসিন এবং তার দল একদিন পূর্ণাঙ্গ বিশ্বজয়ী এক দল হয়ে উঠুক, এই আমাদের কামনা। হুইলচেয়ার ক্রিকেট দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ুক, যথাযথ সম্মান পাক এই লড়াকু মনের যোদ্ধারা এই আমাদের আশা। আগামী টুর্নামেন্টে মহসিনরা আমাদের ক্রিকেট জয়ের স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করবেন- এই যেন হয় ইতিহাস!
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা