সংকটে, সহায়তায়, সচেতনতায় – প্রথম পর্ব

April 7, 2020

দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষেরা আজ প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে। ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম অতিদারিদ্র্য থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এবারের সংকটেও থেমে নেই সেই লড়াই।

অতিদরিদ্রদের বসবাস সমাজের সেই অবহেলিত অলিগলিতে, যেখানে মানুষের সামান্যতম চাওয়াগুলো আজও উপেক্ষিত; যেখানে সাধারণ উন্নয়নের আলো পৌঁছাতে পারে না।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে বদলে গেছে পুরো পৃথিবী। কিন্তু এ সংকটের আগে থেকেই অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে কষ্ট হতো। নিজের ও পরিবারের যে সাধারণ চাহিদা- যেমন খাদ্য বা শিক্ষা, এগুলো  জোগান দেওয়ার জন্য যতটুকু দক্ষতা বা সম্পদের প্রয়োজন, তা অতিদরিদ্রদের কাছে ছিল না, নেই। জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি গবাদি পশু, সুস্থ থাকার জন্য চিকিৎসা বা সেবা এসব কিছুই না থাকাতে তারা বিভিন্ন ছোঁয়াচে এবং প্রতিরোধযোগ্য রোগের শিকার হতেন।

আজ যখন মহামারির কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে আমাদের চিরচেনা আকাশ, তখন আমাদের হিমশিম খেতে হয় এই মানুষগুলোর মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে।

বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে প্রায় সব ধরনের ব্যবসায়, পরিবহন ব্যবস্থা; এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে আলাদা হতে হচ্ছে অন্য সবার থেকে। এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষেরা প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে। ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম অনেক আগে থেকেই অতিদারিদ্র্য থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটেও সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যেন অতিদরিদ্রদের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে মেটানো সম্ভব হয়, উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কার্যক্রমে নিয়ে আসা হয়েছে জরুরি কিছু পরিবর্তন।

ব্র্যাক ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম (অতিদরিদ্র কর্মসূচি) চালু রেখেছে। কোভিড-১৯ মহামারি দেশে আঘাত করার আগে থেকেই অতিদরিদ্রদের জন্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হয়। মাঠকর্মীরা শুরু করে দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নিরাপত্তা ও সচেতনতার কাজ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পরিবারগুলোকে দেখিয়ে দিতে থাকেন হাত ধোয়া ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষার সঠিক নিয়মগুলো।

ব্র্যাককর্মীরা এখনও এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাথে অবলম্বন করছেন সাবধানতা। যে বাড়িতেই যাচ্ছেন, বজায় রাখছেন সামাজিক দূরত্ব, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় থাকছেন না এবং কঠোরভাবে অন্যান্য নিয়ম মেনে চলছেন। সাধারণত কার্যক্রমের কর্মীরা কথা বলেন কর্মদক্ষতা আর আয়ের সুযোগ নিয়ে। কিন্তু এখন দেয়া হচ্ছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জরুরি তথ্য। এছাড়াও অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে পরিচ্ছন্নতার সরঞ্জাম এবং লিখিত নির্দেশনা।

মাঠকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং যে জনগোষ্ঠীসমূহে তারা সেবা দিয়ে থাকেন সেখানে দ্রুত স্বাস্থ্য সচেতনতার তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্র্যাক কোভিড-১৯ নিয়ে তৈরি করেছে অ্যাপ। ‘করোনারোধ অ্যাপ’ নামে এই অ্যাপটি বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে লক্ষণ যাচাই করে এবং লক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দেয় পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত এবং তার আগের সময়টায় করণীয় কাজগুলো কী কী।

তবে এই প্রচেষ্টায় সবাই শুধু স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নয়, আরও বিভিন্ন রকম ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই বিষয়ে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্‌ সম্প্রতি বলেন: “কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যকে সংক্রমিত করতে পারে এমন একটি মানবিক সংকট। বাংলাদেশের মতো দেশে এর অর্থনৈতিক পরিণতিও মারাত্মক। কারণ এটি বিশ্বব্যাপী সংকট, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ তাদের চাকরি হারাচ্ছেন, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উপার্জন।”

এই কারণে, অংশীদাররা এখনও নগদ ভাতা পাচ্ছেন এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বা অর্থনৈতিক অসুবিধা চরম আকার ধারণ করলে তাদের সম্মিলিত সঞ্চয় তহবিল থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন। এই অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই উদ্যোগ কিছুটা নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা বলা যায়। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সবাই সামাজিক দূরত্বের নিয়ম পালন করার কারণে নগর ও মফস্‌সলের বস্তি এবং গ্রামাঞ্চলের দুর্গম এলাকাগুলোয় বসবাসকারী অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবিকা প্রায় নেই বললেই চলে।

ইউপিজি-সহ ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষেরও বেশি পরিবারকে সহয়তা করা হবে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের জন্য ব্র্যাক বরাদ্দ করেছে ১৭.৬ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতিটি পরিবারকে জরুরি খাদ্য সহায়তা হিসেবে ১,৫০০ টাকা কয়েক সপ্তাহের খাবারের জন্য সরবরাহ করা হবে। লকডাউনে যাদের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, তাদের জন্য ব্র্যাকের কর্মীরা স্থানীয় সরকার এবং ইউনিয়ন পরিষদ এর সাথে যোগাযোগ করে বাড়তি সরকারি সহায়তা- যেমন চাল, তেল, স্বাস্থ্যকর পণ্য এবং অতিরিক্ত নগদ ভাতা’র জন্য ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশের বাইরের যে দেশগুলোতে ব্র্র্যাক কাজ করছে, সেখানেও নেওয়া হচ্ছে এমন সব উদ্যোগ। গ্র্যাজুয়েশন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীরা যেন নিয়মিত সহায়তা পেতে থাকেন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদেরকে দ্রুত পৌঁছে দেয়া হয়, এ উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

সংকটে অবিচল থেকে আমাদের দাঁড়াতে হবে বিপন্ন মানুষের পাশে, থাকতে হবে অকুতোভয় এবং সচেতন। এই লেখার দ্বিতীয় পর্বে আমরা আলোচনা করবো কোভিড-১৯ সংকট প্রতিরোধ করার পাশাপাশি বিশ্বের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে দেশের বাইরে ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন কার্যক্রমগুলো কী পদ্ধতি ব্যবহার করছে। বিশেষ করে ফিলিপাইন এবং উগান্ডার কর্মসূচিগুলো কীভাবে প্রযুক্তি ও পূর্ব-সতর্কতা ব্যবহার করে সবাইকে সচেতন রাখছে তা তুলে ধরা হবে।

 

মূল লেখা:
http://blog.brac.net/meeting-basic-needs-of-the-worlds-poorest-during-a-time-of-crisis-part-1/

অনুবাদে: তানজীম ওয়ালিদ রহমান, সুহৃদ স্বাগত

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Maujudul Islam
Maujudul Islam
4 years ago

সত্যিই ব্র্যাকের সকল উন্নয়ন কর্মসূচি অতুলনীয়। দেশের সবাই যখন আতঙ্কে, ক্ষুধায় দিশেহারা, ঠিক সে সময়ে ব্র্যাক তার সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করল এবং বিভিন্নমুখী সহায়তার মাধ্যমে মানুষকে আবার বাঁচার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিল।