লবণ-গুড় স্যালাইন : উন্নয়নে ওটেপ একটি গেম চেঞ্জার

August 30, 2020

ডায়রিয়ার প্রকোপ যেখানে বেশি সেই গ্রামাঞ্চলে এটি কোনোভাবেই পৌঁছানো সরকার বা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তার ওপর রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যয়। তখন বলা হতো যে, প্রতিটি ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে যদি দু প্যাকেট স্যালাইন ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা প্রজাতন্ত্রের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য বাজেট ছাড়িয়ে যাবে। একটা বিকল্প হিসেবে মনে হলো যদি মানুষকে ঘরে বসে এই স্যালাইন বানানোর কৌশল শেখানো যায় তাহলে কেমন হয়?

উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনো দেশ বা এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হলে তাদের জীবনযাত্রা এবং সমস্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, বুঝতে হয় কোথায় তারা পিছিয়ে। আজ থেকে প্রায় ৪ দশক আগে, যখন বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির সুবিধাটুকু ছিল কেবল আমাদের কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তখন মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করাটা ছিল এক প্রবল চ্যালেঞ্জ।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সূচকগুলো তখন বিশ্বের প্রায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশি শিশুদের এক-চতুর্থাংশই তাদের পঞ্চম জন্ম দিবসের আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। একইভাবে মাতৃমৃত্যু হারও ছিল অত্যধিক, প্রায় ১ হাজারের কাছাকাছি। এই অবস্থার উন্নতিকল্পে ব্র্যাক প্রথমেই সিলেটের শাল্লা এলাকায় ৪টি ক্লিনিক চালু করে। মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তারদের বেশিদিন সেই অজপাড়াগাঁওয়ে ধরে রাখা যায়নি। এই সংকট মোকাবিলায় ব্র্যাক সিদ্ধান্ত নেয় যে, এমবিবিএস ডাক্তারদের পরিবর্তে ডিপ্লোমা বা এ ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেবে। স্থানীয় এগারোজন যুবককে প্যারামেডিক হিসেবে প্রশিক্ষিত করে ক্লিনিকের বিভিন্ন দায়িত্বে বসানো হলো। কিন্তু এবার দেখা দিল নতুন আরেক সমস্যা। স্থানীয় হওয়ার কারণে এসব প্যারামেডিকরা নিজেরাই ডাক্তারির পসরা সাজিয়ে বসল। ফলে ব্র্যাকের কর্মতৎপরতায় স্থবিরতা নেমে এলো। এবারে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্যারামেডিকের বদলে স্বাস্থ্যসেবিকা নিয়োগ দেওয়া হবে। ব্র্যাকের উদ্ভাবিত এই স্বাস্থ্যসেবিকা কার্যক্রম এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে। প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্সদের অভাবে এরাই এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার হাল ধরে আছেন।

১৯৭৯ সাল। বছরটি ছিল আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ। বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে কী ধরনের কার্যক্রম নেওয়া যায়, তা বিবেচনার লক্ষ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। বেশ কিছু সদস্যের সঙ্গে সেই কমিটিতে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ফজলে হাসান আবেদও ছিলেন। তখনকার কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির (বর্তমান আইসিডিডিআর’বি) হেনরি মোসলে এবং লিংকন চেনও একই কমিটিতে ছিলেন। আবেদভাই তার বন্ধু রকফেলার ফাউন্ডেশনের জন রোডীসহ কয়েকজনের সঙ্গে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে ঠিক হলো, ব্র্যাক একটি ডায়রিয়া প্রতিষেধক কর্মসূচি হাতে নেবে।

ডায়রিয়া একটি প্রাণহারী রোগ। সত্তর দশকের প্রথম দিকে বছরে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি ডায়রিয়াজনিত পানি শূন্যতায় মারা যেত, যার সিংহভাগই ছিল শিশু। ডায়রিয়ার প্রকোপ পৃথিবীর সব অঞ্চলেই দেখা যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ডায়রিয়ার ফলে একসময় বাংলাদেশে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ডায়রিয়া একটি সমষ্টি রোগের নাম। এর নানা রূপ আছে। তবে ভয়াল রূপ হলো কলেরা। কার্যত ডায়রিয়ার চিকিৎসা কিন্তু কোনো কঠিন কাজ নয়। রোগের কারণে যে পরিমাণ তরল পদার্থ শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তার সমপরিমাণ তরল সঠিকভাবে শরীরে পূরণ করাই হলো এর কার্যকর চিকিৎসা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সবচাইতে নিরাপদ ব্যবস্থা হচ্ছে স্যালাইনের সব উপাদান একটি প্যাকেটের মধ্যে পুরে তা বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ডায়রিয়া রোগীকে খাওয়ানো। প্যাকেটের সব উপাদান এক লিটার পানিতে ঢেলে তা ভালো করে নেড়ে প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর খাওয়াতে হবে। কিন্তু সত্তর দশকের শেষের বাংলাদেশে এটিকে সম্ভাব্য বাস্তব পন্থা বলে মনে হয়নি। বিরাজমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

ডায়রিয়ার প্রকোপ যেখানে বেশি সেই গ্রামাঞ্চলে এটি কোনোভাবেই পৌঁছানো সরকার বা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তার ওপর রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যয়। তখন বলা হতো যে, প্রতিটি ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে যদি দু প্যাকেট স্যালাইন ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা প্রজাতন্ত্রের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য বাজেট ছাড়িয়ে যাবে। একটা বিকল্প হিসেবে মনে হলো যদি মানুষকে ঘরে বসে এই স্যালাইন বানানোর কৌশল শেখানো যায় তাহলে কেমন হয়? কিন্তু বিপত্তি হলো কীভাবে লবণ, গুড় ও পানির পরিমাণ ঠিক করা হবে।

ইন্দোনেশিয়ায় সে সময় একটি ডায়রিয়া চামচ উদ্ভাবিত হয়েছিল, যার ছিল দুটো প্রান্ত। এক প্রান্তে মাপা হবে লবণ আর অন্য প্রান্তে চিনি বা গুড়। জন রোডী এই চামচের একটি নমুনাও সঙ্গে করে ঢাকায় এনেছিলেন। নতুনত্বের কারণে এই উদ্ভাবনকে সকলেই সাধুবাদ দিলেন কিন্তু একটি কারণে খুব বেশি দূর এগোনো গেল না। আর তা হলো এর স্থায়িত্ব। যদি চামচটি হারিয়ে যায় কিংবা ভেঙে যায় তাহলে কী হবে? বাদ পড়ে গেল এই উদ্ভাবন। আরও কিছু বিকল্প চিন্তা এলো, কিন্তু এগুলোর গুণাগুণ বিচারে শেষ পর্যন্ত টিকে গেল একটি ফর্মুলা। আর তা হলো ‘এক চিমটি লবণ আর এক মুঠ গুড়’। ব্র্যাকের পুরনো কর্মী সুখেন্দ্র কুমার সরকারের নেতৃত্বে শুরু হলো পাইলট প্রকল্প-শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ আর বানিয়চং থানায়। এমন সময় সুদূর আমেরিকা থেকে টেড এলারব্রক নামে এক তরুণ ডাক্তার এসে যোগ দিলেন এই প্রকল্পে। তিনিই প্রধানত টেকনিক্যাল এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি দেখতেন এবং ঢাকাস্থ আইসিডিডিআরবি’র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। পাইলট প্রকল্পের প্রধান দুটো লক্ষ্য ছিল। লবণ-গুড়ের ফর্মুলা মাঠপর্যায়ে নিখুঁতভাবে স্থানান্তরিত করা এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেক মা-কে এই ফর্মুলায় স্যালাইন বানানো শেখানো।

কিছুসংখ্যক স্থানীয় উদ্যমী মহিলা যাদের বয়স ২০-২৫ বছরের মধ্যে ছিল তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হলো। এই নতুন কর্মীদের নাম দেওয়া হলো ওরাল রিপ্লেসমেন্ট ওয়ার্কার বা ওআরডব্লিউ। ‘মনে রাখার মত সাতটি পয়েন্ট’-এর মাধ্যমে শুরু হলো শিক্ষা কার্যক্রম। এভাবে প্রায় ছয়মাস চলল এই পাইলট প্রকল্প। তখন কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে, ব্র্যাকের এই উদ্যোগ একসময় ব্র্যাক তথা বাংলাদেশের শিশুদের জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। কর্মসূচির নাম দেওয়া হলো ‘ওরাল থেরাপি প্রোগ্রাম’ সংক্ষেপে ‘ওটেপ’।

পাইলট পরবর্তী এক দশক ধরে ব্র্যাকের হাজার হাজার কর্মী বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে মায়েদেরকে লবণ-গুড় দিয়ে কীভাবে স্যালাইন বানাতে হয় এবং ডায়রিয়া হলে কীভাবে তা খাওয়াতে হয় সেটা শিখিয়েছেন। কর্মসূচি চলাকালে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা প্রসূত নানা উদ্ভাবনী যোগ করে একে পরিপূর্ণতার পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই যে, ব্র্যাকের এই যুগান্তকারী কাজের ফলে বাংলাদেশে ওয়াটারি ডায়রিয়ায় মৃত্যুহার আজ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আর মুখে খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার তো পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রায় পঁচাশি ভাগ ডায়রিয়া রোগী এখন এই স্যালাইন ব্যবহার করছে। ব্র্যাকের এই সাফল্য বক্ষে ধারণ করে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

 

সংক্ষিপ্ত লেখাটির পূর্ণ সংস্করণ পড়তে ক্লিক করুন

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments