লকডাউনের দিনগুলি

July 14, 2020

এলাকা থেকে বাইরে যেতে বা ভেতরে আসতে হলে নির্দিষ্ট খাতায় যাতায়াতের কারণ এবং নিজ বাসার ঠিকানা লিখতে হবে। রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, শুকনো ও কাঁচা বাজার নিয়ে অবস্থান করছে অনুমতিপ্রাপ্ত কোম্পানির গাড়ি। এছাড়াও বিনামূল্যে শাকসবজি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাক। ওষুধের দোকানগুলো খোলা থাকার ঘোষণা তো আছেই। সিটি কর্পোরেশনের অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে দেয়া একটি বিশেষ পলিব্যাগে মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস জমিয়ে রাখতে বলা হয়েছে যা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেই আমার ছেলেবেলার মতো, রাস্তাটা আজ শুনসান।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধী করে তোলার একটি উপায় হলো, বেশি সংক্রমিত এলাকায় লকডাউন দিয়ে আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের আলাদা রেখে চিকিৎসা করা এবং সুস্থ করে তোলা। এর ফলে ভাইরাস আর ঐ এলাকায় বংশবৃদ্ধি করতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় এলাকায় ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠলে সেখানে যদি নতুন করে করোনায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি আসেনও, দেখা যাবে তার চারপাশের বেশিরভাগ মানুষের দেহেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে আছে। ফলে সে নতুন আশ্রয় পাবে না এবং শেষ পর্যন্ত ওই এলাকায় ভাইরাস বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের আজ ঘরে থাকা।

করোনাভাইরাসের দাপটে আমি আছি লকডাউনে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হবেন না- একথা প্রায়ই মাইকিং করা হচ্ছে। এলাকা থেকে বেরোনোর প্রায় সবগুলো পথই মানুষ সমান বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া। যে দুটি পথ খোলা আছে সেখানে দায়িত্বপালন করছেন পুলিশ, আছেন বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।

এলাকা থেকে বাইরে যেতে বা ভেতরে আসতে হলে অনুমতি নিতে হবে। নির্দিষ্ট খাতায় যাতায়াতের কারণ এবং নিজ বাসার ঠিকানা লিখতে হবে। আগামী কিছুদিন এভাবেই বিচ্ছিন্ন থাকবে ওয়ারীবাসী।

বাসায় থেকে অফিস করা আর সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করেই আমার কাটছে দিন। রাস্তার পাশে বাড়ি। বাসার বারান্দাটিও রাস্তার ধারে, যা এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। এখানে দাঁড়ালে দেখা যায় রাস্তায় মানুষের চলাচল। এখন তো আর দরকার ছাড়া কেউ বের হচ্ছেন না। তবুও দেখি, কেউ কেউ এলাকার ভেতরেই সেরে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় কাজ, সকালে কেউ কেউ বের হচ্ছেন হাঁটতে। শোনা যায় পাখির ডাক, তারা যেন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে মাতোয়ারা।

লকডাউনের মধ্যে বাজারসদাই কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তা ছিল। করোনাকালের শুরু থেকেই বাড়ির কাছে ভ্যান আসত বাজারের নানা পণ্য নিয়ে। কেনাকাটি করতে খুব একটা বাইরে বেরোতে হয়নি। কিন্তু লকডাউনে তো আর তা সম্ভব নয়। সেজন্যই মাসের বাজার লকডাউনের আগের দিন তাড়াহুড়ো করে কিনে নিই। আমার মতো অনেকেই হয়তো করেছেন, তাই তো সুপারশপ, দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ের খবরটি উঠে এসেছিল অনেক সংবাদ মাধ্যমে।

লকডাউন শুরু হবার পর বুঝলাম এত হুড়োহুড়ি না করলেও পারতাম। সুপারশপগুলোতে ফোন করে বা অনলাইনে অর্ডার দিলেই তারা বাজার পৌঁছে দিচ্ছে বাড়ি বাড়ি। তারপরও রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, শুকনো ও কাঁচা বাজার নিয়ে অবস্থান করছে অনুমতিপ্রাপ্ত কোম্পানির গাড়ি। যদি দেখেশুনে কেনার ইচ্ছে থাকে তাহলে সেখানেও যাওয়া যায়।

এছাড়াও বিনামূল্যে শাকসবজি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাক। যাদের প্রয়োজন তারা লাইন ধরে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সবজি নিয়ে নেন। ওষুধের দোকানগুলো খোলা থাকার ঘোষণা তো আছেই। তবে রাস্তায় বের হলে অবশ্যই পরতে হবে মাস্ক, মানতে হবে সামাজিক দূরত্ব।

এই সেদিন সকালে সিটি কর্পোরেশনের অফিস থেকে বাসায় একটি বিশেষ পলিব্যাগ পৌঁছে দিয়ে গেল। মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস এই ব্যাগে জমিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। এটি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমে। সেইসাথে সাধারণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটিও চলছে নিয়মিতভাবে।

এক লাখেরও বেশি মানুষের বাস এখন ওয়ারীতে। এরমধ্যে প্রায় দুইশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের বাড়ি থেকে দু-রাস্তা পর ওয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়। দেখা গেছে, এক সপ্তাহে লকডাউনে যারা সেখানে নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছেন তাদের ৫০ ভাগের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আগে ভাবিনি এ এলাকায় এত মানুষ আক্রান্ত। তাই তো আজকাল নিজেদের পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে কারও কারও করোনা আক্রান্তের খবর পাচ্ছি।

যে কেউ বিশেষ প্রয়োজনে কন্ট্রোলরুমে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন। করোনা আক্রান্ত রোগী বা করোনা মুক্ত রোগী উভয়ের জন্য রয়েছে ডাক্তরের টেলিমেডিসিন পরামর্শ নেবার সুযোগ। উভয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে রয়েছে আলাদা আলাদা অ্যাম্বুলেন্স সেবার ব্যবস্থা। যাদের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে, তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নয়াবাজারে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের অধিকাংশ বাসায় চিকিৎসা নিতেই আগ্রহী।

লকডাউনে বন্ধ রয়েছে এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, দোকান, রেস্তোরাঁ, শপিংমলসহ সবকিছু। আবার এলাকার বাইরে গিয়ে চাকরি বা ব্যবসা যারা করেন তারাও সাধারণ ছুটির আওতায় কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছেন না। যাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখি- এই মনোভাব থেকে দু-চার জন বের হন ঠিকই কিন্তু যথাযথ কারণ দেখাতে না পারলে বা পূর্ব অনুমতি না থাকলে তা আর হয়ে ওঠে না।

লকডাউনে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের নিয়মিত জীবনে বিঘ্ন ঘটেছে, কিছু অসুবিধাও হচ্ছে। কিন্তু একথাও বলতে চাই, করোনা প্রতিরোধের নানা চেষ্টায় মিশে থাকুক আমাদের এলাকাবাসীর এই চেষ্টা। যদি সবার ভালো হয়, এই আশায় আমরা লকডাউন মেনে চলি।

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments