বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল ৮৪,৬৯০ জন এবং ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০,৫২৩ জনে। এই দশ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭.৬ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ।
২৫শে এপ্রিল ২০১৯ তারিখে পালিত হয়েছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমিই করব ম্যালেরিয়া নির্মূল’।
ম্যালেরিয়া একটি প্রাচীন রোগ, বহুকাল ধরেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রায় ৫ লক্ষ বছর ধরে মানুষ এই মরণব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং এটিই সত্য যে, তা নির্মূল করা এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এই মরণব্যাধির টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে। সেইসঙ্গে ম্যালেরিয়া নির্মূলে যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তাতে রোগের প্রকোপ ও মৃত্যুহার দুইই কমে এসেছে। বাংলাদেশে এর সাফল্য আশাব্যাঞ্জক।
প্লাজমোডিয়াম নামের এক ধরনের পরজীবীর সংক্রমণে ম্যালেরিয়া রোগ হয়। এই রোগে সাধারণত কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সেইসঙ্গে মাথাব্যথা, বমি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়। মশার কামড় থেকে এ রোগ ছড়ায়। অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী-মশা ম্যালেরিয়া জীবাণুর বাহক। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার মারা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১২ লক্ষ ৪০ হাজার এবং মৃত্যুবরণ করেছে ২৯৯ জন।
ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-দেশের এই তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হবার এবং এই রোগে মৃত্যুবরণের হার সবচাইতে বেশি। তাই এই জেলাগুলোকে উচ্চম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ম্যালেরিয়া ঝুঁকি এড়াতে সরকার ও অন্যান্য এনজিও যৌথভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পও অন্তর্ভুক্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই এলাকাগুলোতেই দেশের ৯০ শতাংশ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে। ২০১৮ সালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মোট ১০,৫২৩ জন। এর ৭ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু এবং ০.৪১ শতাংশ গর্ভবতী মা। লেংরাং ম্রো সেই গর্ভবতী মায়েদের একজন।
লেংরাং ম্রো একজন জুমচাষি। ২০ বছর বয়সি কর্মঠ নারী। বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার বাস। জুমচাষ করার জন্য তাকে নৌকা, পায়ে হেঁটে, পাহাড় ডিঙিয়ে প্রতিদিন বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হয়। পথের এই কষ্টে সে অভ্যস্ত। এ ছাড়া তার অন্য কোনো উপায়ও নেই। এমনকি তিনি যখন গর্ভবতী তখনও হয়তো তাকে এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, কিন্তু বাদ সাধল প্রচ- জ্বর। তিন মাসের গর্ভাবস্থায় তিনি প্রচ- জ্বরে আক্রান্ত হলেন। লেংরাং প্রথমে ভেবেছিলেন সামান্য জ্বরই তো, কদিন পরেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু যখন জ্বরের মাত্রা বাড়তেই থাকল এবং কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিলেন না তখন তিনি ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকার পরামর্শে ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করান। পরীক্ষায় তার ম্যালেরিয়া রোগ ধরা পড়ে। এরপর দ্রুত তাকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আজ লেংরাং এবং তার সন্তান দুজনেই ভালো আছেন, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। স্বাস্থ্যসেবিকার একটি পরামর্শ দুটি জীবন বাঁচিয়ে দিল। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকাদের ঝুলিতে জমা আছে এরকম অসংখ্য গল্প। তার কিছু হয়তো আমরা জানি তবে বেশিরভাগই অজানা রয়ে যায়।
কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে
বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল ৮৪,৬৯০ জন এবং ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০,৫২৩ জনে। এই দশ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭.৬ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। এর কৃতিত্ব অবশ্যই জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির। তাদের কার্যক্রমের কল্যাণেই নিয়ন্ত্রণ পর্যায় থেকে নির্মূল পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং দ্য গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তায় ব্র্যাক ও অন্যান্য এনজিও যৌথভাবে ম্যালেরিয়া নির্মূলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য, এই যৌথ কার্যক্রমে এনজিওদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্র্যাক।
ম্যালেরিয়া নির্মূলে এদেশে একটি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, তত্ত্বাবধান করা, ম্যালেরিয়া শনাক্ত করার কিট ও অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার ওষুধ এবং কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ, উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের বিশেষভাবে সচেতন করা এবং যেসব এলাকায় ম্যালেরিয়া নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে তা পর্যালোচনা করা।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ
ম্যালেরিয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে কমে এসেছে ঠিকই কিন্তু মানবিক বিপর্যয়ের কারণে মিয়ানমার থেকে এদেশ চলে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কর্মসূচির অগ্রগতি কখনও কখনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। ঘন ঘন অভিবাসন, ভাষা বুঝতে না পারা এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান রাজনীতি এক্ষেত্রে বড়ো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনা করে দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করতে আমাদের আবার নতুনভাবে ভাবতে হবে। কর্মকৌশলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে যেসব উদ্যোগ ও কর্মকৌশলে আমরা এগোচ্ছি তার সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগাতে পারি।
যা করতে চাই
ম্যালেরিয়া নির্মূল কার্যক্রমের সাফল্য যেন ক্ষণস্থায়ী না হয় সেজন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ২০১৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বেশ ভালোর দিকে, এক শতাংশেরও কম (০.২%)। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধনের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই অর্জন আমাদের কাছে আরও এগিয়ে যাওয়ার দাবি রাখে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণরূপে ম্যালেরিয়ামুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকার ও ব্র্যাক একত্রেই কাজ করবে বলে আশা করা যায়।