মেঘ দূর করা আলো

September 17, 2020

প্রকৃতির এই বৈরি খেয়ালের মাত্রা বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বেড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অসহায় দেশবাসী। অনেকেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল, কেউ কেউ হয়েছেন নদী ভাঙনের শিকার। কিছুদিন আগেও যে স্কুলকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত শিক্ষার্থীরা, তাদের সামনে এখন শুধু নদীর অথৈই জল। স্কুলটিকে ঘিরে বাচ্চাগুলোর কত স্বপ্ন, কত আনন্দ ছিল, কিন্তু সবই মিলিয়ে গেল নির্মম ও কঠিন বাস্তবতায়।

এ গল্পটা একের পর এক যুদ্ধ জয়ের। না, অস্ত্রের ঝনঝনানির কোনো যুদ্ধ নয়, নয় কোনো বোমা মেরে ভূখণ্ড উড়িয়ে দেওয়ার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ জীবন যুদ্ধ। বলা যায়, বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে সবসময় লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে চলতে হয়। জীবনব্যাপী এ লড়াই চলে তার নিজের সাথে, আশেপাশের সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে।

চেষ্টা ও পরিশ্রম করলে সমাধান আসবে- এই আশায় মহামারির দুর্দিনেও নতুন করে পথ চলা শুরু করেন নাটোরের শুকুর আলী।

দিশেহারা শুকুর আলী চোখের সামনে দেখেছেন, চাহিদা মতো জিনিস না পেয়ে ক্রেতারা পাশের দোকান থেকে জিনিস কিনছেন। তার চেনা-পরিচিত কাস্টমারও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে তখন লকডাউন চলছিল। এর মধ্যে বিক্রির চাহিদা বেড়েছিল কিন্তু টাকার অভাবে তিনি দোকানে জিনিস তুলতে পারছিলেন না। একজন ব্যবসায়ীর জন্য এ ভীষণ বিপদ! তবুও তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন কারণ ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে ঋণ কার্যক্রম শুরু হওয়া মাত্র তিনি সেখান থেকে টাকা তোলেন। শুধু ঋণ প্রদান নয়, গ্রাহকের সঞ্চয় ফিরিয়ে দেওয়া, সীমিত সময়ের জন্য কিস্তি গ্রহণ বন্ধ রেখে সহমর্মিতা নিয়ে প্রথম থেকেই ব্র্যাক মানুষের পাশেই ছিল।

প্রকৃতির সাথেও চলে চলে টিকে থাকার লড়াই; সে লড়াইটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয় বরং প্রকৃতির বৈরিতার বিরুদ্ধে। দূষণ, আধুনিক নগরায়নের চাপে দিশেহারা প্রকৃতির খেয়ালি আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষকে লড়াই করতে হয় কখনও কখনও। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এ যেন অমোঘ সত্য। প্রায় প্রতি  বর্ষায় আমরা আমাদের এই প্রিয় ভূখণ্ডকে বন্যার পানিতে ভাসতে দেখি, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।  লড়াইয়ের এক ছকে যেন বাঁধা পরে আছে মানুষের জীবন। দুঃসময়কে জয় করতে চেষ্টা করছি আমরা।

এ জাতি সত্তরের জলোচ্ছ্বাস দেখেছে। আবার পরের বছরই স্বাধীন সূর্যের আলোয় দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একানব্বইয়ের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের বিপর্যয় কাটিয়ে এখন সেই উপকূলের নিচেই রয়েছে আমাদের সাবমেরিন ক্যাবল; যা তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এসবই মাথা উঁচু করার গল্প, জাতি হিসেবে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার লড়াকু গল্প।

প্রকৃতির এই বৈরি খেয়ালের মাত্রা বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বেড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অসহায় দেশবাসী। অনেকেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল, কেউ কেউ হয়েছেন নদী ভাঙনের শিকার। কিছুদিন আগেও যে স্কুলকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত শিক্ষার্থীরা, তাদের সামনে এখন শুধু নদীর অথৈই জল। স্কুলটিকে ঘিরে বাচ্চাগুলোর কত স্বপ্ন, কত আনন্দ ছিল, কিন্তু সবই মিলিয়ে গেল নির্মম ও কঠিন বাস্তবতায়। এবারের বিপর্যয়টা অবশ্য ভিন্নমাত্রা ধারণ করেছে। একদিকে করোনার থাবা, অন্যদিকে কখনও প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়, আবার সবশেষ সর্বগ্রাসী বন্যা।

শুধু বিপর্যয়কে কাটিয়ে ওঠা নয়, নতুন স্বাভাবিকতা বা নিউ নরমাল জীবনের সাথে সবাই খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছি। খুলে যাচ্ছে শহরের দুয়ার। সচেতন মানুষ এখন ভীতি কাটিয়ে আগামী দিনগুলোতে করোনা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে।

স্বপ্ন দেখি, নদীর গ্রাসে যে স্কুল বিলীন হয়ে গিয়েছিল, সেখানকার ছোট্ট ছেলেমেয়েরাই একদিন আবার জাগিয়ে তুলবে শিক্ষাকে। নদীতে নির্মিত সেতু দু’পাশের মানুষের অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেবে। প্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো টাকায় আদরের বোনটি তার পড়ার খরচ মেটাবে, পড়বে নতুন জামা জুতো।

করোনাভাইরাস, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং সর্বশেষ বন্যা- একের পর এক আঘাত মোকাবিলায় মানুষের পাশে থেকে অবিরাম কাজ করছে ব্র্যাক। সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে সেই সব মানুষের কাছে যাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

এখানে বলতে হয় রাজশাহীর হাসিনার গল্প। তিনি ও তার স্বামী দুজনে দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালান। এবারের এই দুর্যোগকালে কীভাবে তার সংসার চলে? ঘরে চাল নেই, সদ্য তিনি মা হয়েছেন অথচ তার জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা নেই, নেই অসুস্থ শাশুড়ির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার টাকা। চরম সংকটের মুখোমুখি হাসিনাকে এক সন্ধ্যায় জানানো হলো ব্র্যাকের পক্ষ থেকে  তাকে অর্থ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। যারা খুব কষ্টে খেয়ে-না খেয়ে কোনোরকমে দিন যাপন করছিল তাদেরকে তালিকাভুক্ত করে সাধ্যমতো সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে ব্র্যাক। এ কাজে ব্র্যাক নিজস্ব অর্থ ব্যয় করা ছাড়াও অনুদান সংগ্রহ করেছে। একসাথে সবাই মিলে ভালো থাকার স্বপ্নটা আসলে এগিয়ে যায় এভাবেই।

বিপর্যস্ত এই প্রকৃতির বৈরিতাকে পাশ কাটিয়েই এদেশের মানুষ দিনের পর দিন নিজেকে ইস্পাততুল্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। লড়াই করে প্রতিকূলতাকে জয় করে মানুষ গড়বে তার চির আকাঙ্ক্ষিত সুন্দর পৃথিবী, এই প্রত্যাশা দেশ-জাতি-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে পৃথিবীর সকল মানুষের।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments