এই সময়েও নারীদের ওপর নির্যাতন থেমে নেই। এজন্য কর্মসূচির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সেক্টর স্পেশালিষ্ট কাউন্সিলিং আপার মাধ্যমে অনলাইনে টেলি কাউন্সিলিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমন নারীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদেরকে মানসিকভাবে কিছুটা হালকা করার চেষ্টা করি।
ছোটবেলায় মা-বাবাকে দেখতাম, প্রয়োজনে নিজের কাজ বাদ দিয়ে প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যেতে। বিপদ কেটে গেলে সেই পরিচিত মানুষেরা যখন আবার আমাদের বাড়িতে আসতেন কৃতজ্ঞতা জানাতে, তখন আমার ভীষণ ভালো লাগত।
মানুষ নাকি নিজেই নিজের স্বপ্ন বুনে, যা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নেয়। আমি নিজের জীবনের কথাই বলছি। ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির সিনিয়র জেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে বর্তমানে আমি কাজ করছি, খুলনা ও নড়াইল জেলার দায়িত্বে রয়েছি।
আমি সবেমাত্র তখন মাস্টার্স শেষ করলাম যখন এলাকার খাবার পানিতে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। স্বেচ্ছাশ্রমে দলবল নিয়ে যোগ দিলাম ইউনিয়নের সকল টিউবয়েলের পানির আর্সেনিক পরীক্ষা করতে। এ কাজ করে বরাদ্দ পেলাম অনেকগুলো গভীর নলকূপ। দূর হলো এলাকার সুপেয় পানির সমস্যা।
পরে আরেকটি সংস্থায় কাজ করার সময়ে এলো প্রলয়ঙ্করী সিডর ও আইলা। তখনও আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছি। অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো যেন আমার নেশা। আমি না চাইলেও ওরা যখন কৃতজ্ঞতা জানাত তখন এ কাজ করার ইচ্ছা আরও বেড়ে যেত।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ যেন আমার বেড়েই চলছিল। ২০১২ সালের শেষদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কার্যক্রম কম্পোনেন্টে জেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচিতে যোগ দেই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারীরা আজ কতভাবে নির্যাতিত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের মনের কষ্ট কিছুটা লাঘব করার উদ্দেশ্যে একাধিকবার সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলিং প্রশিক্ষণ নিয়েছি।
বর্তমানে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নামক ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণে সমগ্র মানবজাতি ভীতসন্ত্রস্ত। এই সময়েও নারীদের ওপর নির্যাতন থেমে নেই। এজন্য কর্মসূচির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সেক্টর স্পেশালিষ্ট কাউন্সিলিং আপার মাধ্যমে অনলাইনে টেলি কাউন্সিলিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমন নারীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদেরকে মানসিকভাবে কিছুটা হালকা করার চেষ্টা করি।
এই তো সেদিন পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার শারীরিক প্রতিবন্ধী রিনা আক্তার (ছদ্মনাম) এলাকার বখাটের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। রিনার ভাইয়ের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বোনের ওপর বর্বর নির্যাতনের কথা বলছিল। সমাজের একজন পুরুষ হিসেবে ওর ভাইয়ের কথা শুনে আমার খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু তাকে বুঝতে দেইনি। ঘটনাটা ছিল এরকম–মাস্টার্স পড়ুয়া রিনা টিউশনি করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া ছোটবোন ও মাকে নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতো। ভাই পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে। সে একটি ছোটখাটো কাজ করে। প্রতিবেশি এক ছেলে রিনাকে প্রায়ই উত্যক্ত করে। সেদিন সে প্রতিবাদ করলে তাকে কাঠের চলা দিয়ে মেরে পা ভেঙ্গে দেয় । প্রায় দেড় মাস বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করে। এজন্য মায়ের গহনা বিক্রি ও ধারদেনা করে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু এখনও সুস্থ হয়নি রিনা।
এরকম একটি সময়ে রিনার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় যখন সে হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আমি বিষয়টি আমাদের রিজিওনাল ম্যানেজার ও সংশ্লিষ্ট সিনিয়র জেলা ব্যবস্থাপকের কাছে জানালে তিনি হাসপাতালে গিয়ে রিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রধান কার্যালয় থেকে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা বাবদ ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করিয়ে রিনার অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেন।
কেন যেন আজ ছোটোবেলার সেই ভালো লাগার স্মৃতিটা বারবার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মৃত্যুঞ্জয়ী আবেদ ভাইয়ের কথা-
‘যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি
তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং তার সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো।’
সম্পাদনা – ইকরামুল কবীর, সুহৃদ স্বাগত