মানবতার বাঁশিওয়ালা

April 19, 2020

আলিম ভাইয়ের পরিচ্ছন্নতা অভিযান দেখে তার অফিস এবং শ্বশুরবাড়ি এলাকার অন্তত ১৫-২০ জন মানুষ নিয়মিত তাদের বাড়ির চারপাশ জীবাণুমুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। অফিসে ঢোকার সময় সকলে যেন নিয়ম মেনে হাত ধুয়ে নেন, সেদিকটাও দেখেন তিনি। তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই, দিনরাত এভাবে তিনি কিছু-না-কিছু করেই চলছেন।

২০১১ সাল থেকে মোঃ আব্দুল আলিম ব্র্যাকে আছেন। আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম (ইউপিজি)-এর পটুয়াখালী এরিয়া অফিসে তিনি বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন।

সারাবিশ্ব যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন আলিম ভাই তার মতো করে কাজ শুরু করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, চারপাশ পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রেখে সবাইকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখবেন। অফিসের গলি থেকে একটু দূরে বড়ো রাস্তায় সরকারি গাড়ি এসে জীবাণুনাশক স্প্রে করে যায়, কিন্তু অলিগলিগুলোর কী হবে? সে জায়গাগুলো তো জীবাণুমুক্ত রাখা প্রয়োজন। তাই আলিম ভাই শ্বশুরবাড়ি থেকে স্প্রে-মেশিন নিয়ে এসে প্রথম শুরু করলেন চারপাশ পরিস্কার রাখার অভিযান।

আলিম ভাই শুধু রান্না করতেই অভিজ্ঞ নন, সেইসঙ্গে একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্র্যাককর্মী। ভোরবেলা নাশতা বানানো দিয়ে শুরু হয় তার ডিউটি। দেশের এই দুঃসময়ে যখন পটুয়াখালীর বেশিরভাগ খাবারের হোটেল বন্ধ, তখন প্রতিদিন তিনি খাবার রান্না ও পরিবেশনের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অফিসে আসা ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির কর্মীদের তিনি এভাবেই কাজ করার শক্তি জুগিয়ে চলেছেন।

সারা দেশের মানুষ যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়ে দিশেহারা, আতঙ্কিত; তখন শুধুই রান্নার দায়িত্বপালন নয়, ব্র্যাকের অন্যান্য কর্মসূচির যে কোনো সাহসী এবং সচেতন কর্মীর মতো আলিম ভাই মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছেন। নিজের কাজ শেষ করে তিনি এরিয়া অফিসের কর্মীদের সাথে গিয়ে পটুয়াখালী শহরের অলিতেগলিতে ব্র্যাকের পক্ষে সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করেন, মানুষের সাথে করোনা থেকে নিরাপদ থাকার উপায় নিয়ে কথা বলেন। এলাকার মানুষকে সচেতন করা যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছে।

পটুয়াখালী থেকে ২০ কিঃমিঃ দূরে আলিম ভাইয়ের বাড়ি। সেখানে থাকে তার পরিবার। তারা তাকে প্রায়ই বলেন বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু আলিম ভাই তাদের বোঝান যে, এই সময়ে তিনি যদি অফিস ছেড়ে চলে যান, তাহলে অফিসে যারা কাজে আসেন তারা কী খাবেন? দুর্যোগের সময় সহকর্মীদের পাশে থেকে তাদের মন ভালো রাখাও তো দরকার। শুধু চাকরির টানে নয়, মানুষের উপকারের জন্যও তো এখন কাজ করে যেতে হবে।

কয়েকদিন আগে হঠাৎ একদিন বিকেলে আলিম ভাইকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল আলিম ভাই কাঁধে একটি ড্রাম নিয়ে উপস্থিত। সেদিনই সে প্রথম জানালো কাছেই তার শ্বশুরবাড়ি, সেখান থেকেই তার হাতিয়ার অর্থাৎ স্প্রে আর ড্রাম আনতে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই তিনি স্প্রে করে চলেছেন। আপন মনে কখনও অফিসের আশপাশ, কখনও রাস্তাঘাট, আবার কখনও স্থানীয় মসজিদের সামনে জীবাণুনাশক স্প্রে করেন। আলিমে ভাইয়ের এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান দেখে তার অফিস এবং শ্বশুরবাড়ি এলাকার অন্তত ১৫-২০ জন মানুষ নিয়মিত তাদের বাড়ির চারপাশ এই পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন।

এখানেই আলিম ভাইয়ের গল্পের শেষ নয়, অফিসে ঢোকার সময় সকলে যেন নিয়ম মেনে হাত ধুয়ে নেন, সেদিকটাও দেখেন তিনি। তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই, দিনরাত এভাবে তিনি কিছু-না-কিছু করেই চলছেন।
আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আলিম ভাই যেন মানবতার এক বাঁশিওয়ালা।

আলিম ভাই বলেন, ‘আমার মতো সামান্য মানুষের কথায় ও কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে একজন মানুষও যদি সচেতন হয় তবে আমি সার্থক। আমি যদি নিরাপদ থাকি আমার অফিস নিরাপদ থাকবে, অফিস নিরাপদ রাখলে আশেপাশের মানুষ নিরাপদ থাকবে, আর মানুষ নিরাপদ থাকলে সমাজ নিরাপদ থাকবে। আমি চাই আমরা সবাই ভালো থাকি, সমাজের সবাই ভালো থাকুক, দেশ নিরাপদে থাকুক।’

 

লেখক মোঃ সোলাইমান ব্র্যাকের আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম-এ জোনাল ম্যানেজার হিসেবে পটুয়াখালীতে কর্মরত আছেন। আলিম ভাই তার সহকর্মী।

অনুলিখন- সুহৃদ স্বাগত
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments