মহামারি থামাতে
পারেনি হয়রানি

May 7, 2020

চলতি বছর বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইউএনএফপিএ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ৮০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াচ্ছেন সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব ‘পুরুষ নির্যাতন’ ট্রল নারী বিদ্বেষী ভাবনা ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়?

কোভিড-১৯ মহামারির এই সংকটময় মুহূর্তে বেশির ভাগ মানুষ বাধ্য হয়ে ঘরে থাকছেন। এ যেন সাধারণ দিনলিপির হঠাৎ ছন্দপতন।

প্রতিদিনের বাইরের কাজ থেকে যখন বাধ্য হয়েই ছুটি মিলল তখন সময় কাটাতে সামাজিক মাধ্যমগুলোর দিকেই সবাই ঝুঁকছে। সংবাদ, বিনোদন, সৃজনশীলতার পোস্টগুলো ফেসবুকের কল্যাণে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ যেহেতু অনেক বেশি সময় ফেসবুকে কাটাচ্ছে, তাই লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করার প্রবণতাও বেড়েছে।

অনেকে মজার ছলে ফেসবুকে নানা মন্তব্য করেন। ঠাট্টা-উপহাস বা মজা করার বিষয়গুলো কখনও কখনও মানুষকে হেয় করার পর্যায়ে চলে যায়। আমরা হয়তো তা বুঝতে পারি না। দেখা যাচ্ছে লকডাউনে নারী-পুরুষ উভয়কেই বাধ্য হয়ে ঘরে থাকতে হচ্ছে, আর ঘরে থাকলে সংসারের কাজ মিলেমিশে করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মানুষ একে নিয়েই ট্রল করা শুরু করে দিয়েছে। এ ধরনের বেশির ভাগ ট্রলেরই বিষয়বস্তু হচ্ছে যে, পুরুষ ঘরের কাজ করছে না বলে নারী নানারকম চাপ প্রয়োগ করছেন কিংবা ঘরে থাকায় পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

আমার পরিচিত কয়েকজন ভদ্রলোক, যারা ফেসবুকে এ ধরনের পোস্ট শেয়ার করেছেন তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি এমন পোস্ট শেয়ার করেছেন কেন? এমন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কি? উত্তরে জানা গেল, তারা নিছক মজা করার জন্যই এসব পোস্ট শেয়ার করেছেন। সেইসঙ্গে একথাও অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কেউই এমন নির্যাতনের শিকার হননি।

এ বছর মার্চ মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক জরিপের ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে, সারা বিশ্বে, প্রতি ১০ জন নারী-পুরুষের মধ্যে ৯ জনই নারীবিদ্বেষী অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রজনন অধিকারসহ নারীর সামগ্রিক কল্যাণ বিরোধী অন্তত একটি বিশ্বাস এই ৯০% মানুষ ধারণ করেন। হয়তো সেই রিপোর্টেরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফেসবুকের ট্রলগুলো ধরা যেতে পারে।

গত ৩১শে মার্চ ২০২০ এ বিবিসি-এর প্রতিবেদক মেঘনা মোহনের প্রতিবেদনের উঠে এসেছে ভারত ও যুক্তরাজ্যে লকডাউন থাকাকালে নির্যাতনের শিকার দুই জন নারীর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কাহিনি। যা সত্যিই আশঙ্কাজনক। চলতি বছর বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইউএনএফপিএ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ৮০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াচ্ছেন সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব ‘পুরুষ নির্যাতন’ ট্রল নারী বিদ্বেষী ভাবনা ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়?

ঘরবন্দি থাকার সময় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পুরুষদের ঘরের কাজ ও শিশু/বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখভালে সাহায্য করতে বলা হচ্ছে, তখন একশ্রেণির মানুষ তাদের নারীবিদ্বেষী বা “misogynistic” মনোভাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মজার ছলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব ট্রলে একদিকে যেমন খুব সুক্ষ্মভাবে পুরুষদের “বিষাক্ত পুরুষত্ব” (toxic masculinity)-কে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, অপরপক্ষে নারীকে হেয় বা অবমাননা করে একধরনের আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা চলছে। নারীকে দেখানো হচ্ছে ভিলেন হিসেবে যেখানে সে পুরুষকে গৃহস্থলি কাজগুলো করতে বাধ্য করছে অর্থাৎ পুরুষ তার “কর্তৃত্ব” হারাচ্ছে।

আবার পুরুষকে ঘরের কাজ করতে বাধ্য করছে বা নির্যাতন করছে এমন নারীদের যেন কোনোভাবেই সহ্য করা না হয় তারই আহ্বান জানানোর জন্য হয়তো করা হচ্ছে এসব ট্রল।

এটাই সঠিক সময় যখন আমরা একটি সুস্থ ও আংশদারিত্বমূলক পরিবার ও সমাজ গঠনের সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। পরিবারের সবার সঙ্গে ঘরে থাকার মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে চমৎকার পারিবারিক বন্ধন, যা পারিবারিক সহিংসতাকে রুখে দিতে পারে চিরতরে।

আসুন পুরুষকে একজন প্রকৃত সহযোগী হতে নানা রকম উৎসাহ প্রদানকারী নিউজ বা পোস্ট শেয়ার করি। লাকডাউনের ফলে সংসারে পুরুষ তার দৈনন্দিন কাজগুলো আত্মস্থ করার সুযোগ পেয়েছে এ বিষয়টিকে যত বেশি উৎসাহ দেয়া যাবে, ততই ‘গৃহস্থলি কাজ কেবলই নারীর’-এ ভাবনা থেকে পুরুষ বেরিয়ে আসবে এবং সংসারের কাজেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে পরিবারে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা পাবে।

 

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা এবং সুহৃদ স্বাগত

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments