ব্র্যাক ফিল্ড মার্শাল

September 28, 2021

আমিন ভাইয়ের সবচাইতে মৌলিক বিশেষত্ব হলো দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ব ও স্নেহবোধ। তিনি যেখানেই গিয়েছেন অথবা কাজ করেছেন, দরিদ্র মানুষ এবং জনগোষ্ঠী তাঁর সেই মমত্ব ও স্নেহের প্রতিদান দিয়েছে।

ব্র্যাককে যাঁরা জানেন, সম্মান করেন ও ভালোবাসেন তাঁদের সকলের জন্য আমিনুল আলমের হঠাৎ অসময়ে মৃত্যুর সংবাদ বিরাট ধাক্কা হয়ে এসেছে। ১৯৭৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এই পঁয়ত্রিশ বছর জুড়ে আমিনভাই ব্র্যাকের সমস্ত মাঠপর্যায়ের কাজের পুরোধা ছিলেন। তাঁর হাতেই ব্র্যাকের রূপকল্প দৃশ্যমান বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের পাশে দাঁড়িয়ে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি মাইক্রোফাইন্যান্স ও সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, মানবাধিকার ও আইন সহায়তা, দুর্যোগ মোকাবেলাসহ সব খাতে ব্র্যাকের কর্মসূচির বিস্তার ঘটিয়েছেন।

আমিনভাই ব্র্যাকের সব কর্মসূচিকে দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে দিতে পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন। তারপর এসব কর্মসূচির অনেকগুলোকে বিশ্বের দশটি দেশে নিয়ে গেছেন। গত বছর ভূমিকম্পবিক্ষত হাইতি আর বন্যাবিধ্বস্ত পাকিস্তানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতেও আমিনভাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অভাবকে সুযোগ আর সমস্যাকে সমাধানে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আমিনভাই প্রসিদ্ধ ছিলেন। দরিদ্র মানুষের অভাব ও প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করা, সেসব অভাব ও প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী মূল গভীর কারণগুলোকে খুঁজে বের করা, বাধা উত্তরণের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সমাধান বের করে সেগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, কার্যকর বলে প্রমাণিত সমাধানগুলোকে কর্মসূচিতে রূপান্তর করা, তারপর সেই কর্মসূচিগুলোর বিস্তার ঘটানো-এই ছিল তাঁর কর্মপদ্ধতি। আবেদভাইয়ের মতো আমিনভাইয়েরও সমস্যাকে কাজের সমষ্টিতে ভেঙে সেগুলোর সুষ্ঠু ও সমন্বিত বাস্তবায়নের জন্য একটা কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার সামর্থ্য ছিল।

একবার আমিনভাই বাংলাদেশের হাওর এলাকার চাষিদের সঙ্গে টানা তিনদিন কাটিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল স্থানীয় কৃষিকাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান বের করা। তিনি স্থানীয় ব্র্যাক কার্যালয়ের কর্মীদের বলে দিয়েছিলেন এই সময়টাতে তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয় আর বলেছিলেন যতক্ষণ বা যতদিন না সমস্যার সমাধান বের হচ্ছে, ততক্ষণ বা ততদিন তাঁদের ম্যারাথন আলোচনা চলতেই থাকবে। আর বলে দিয়েছিলেন মিটিং যতক্ষণ শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ খাবার ও চা-সিগারেটের জোগান যেন না ফুরায়।

সহকর্মীদের সঙ্গে আমিন ভাই

ব্র্যাক যখন পাকিস্তানে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করে আমিনভাই তখন সেখানে গিয়ে প্রথমেই দু’দিনের জন্য গাড়ি ও একজন ড্রাইভার চাইলেন। গাড়িতে করে তিনি ক্রমাগত সেখানকার দরিদ্র মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের প্রয়োজন, সমস্যা আর সুযোগ বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করেন। এখানেও তিনি নির্ভর করেছিলেন ঈশ্বরপ্রদত্ত পর্যবেক্ষণ ও যোগাযোগের সামর্থ্যরে ওপর। অনেকগুলো বিষয়ে আমিনভাই নিজের নৈপুণ্য তৈরি করে নিয়েছিলেন। মাইক্রোফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং, হাঁসমুরগি পালন, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন, বার্ড ফ্লু প্রতিরোধ, কৃষিজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, শিক্ষা ও সাক্ষরতা জ্ঞান, কারুশিল্পী তৈরি ও তাঁদের কর্মসংস্থান, জনস্বাস্থ্য, আইনসম্পর্কিত জ্ঞান ও আইন সহায়তা, দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও দুর্যোগপরবর্তী কর্মকাণ্ড এবং আরও অনেক বিষয়ে তাঁর বাস্তব জ্ঞান ও দক্ষতা প্রসারিত হয়েছিল।

বাংলাদেশে তিনি অনেকগুলো উপার্জনমূলক সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগের জন্য সমন্বিত সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন যার মধ্যে হাঁস-মুরগি পালন, সিল্ক উৎপাদন, কারুশিল্পী তৈরি, সবজিচাষ, মাছচাষ এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। নেতৃত্বদানের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে হাঁস-মুরগির ছানা উৎপাদন ও পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া, রেশমপোকা কীভাবে উৎপাদন করতে হয় ও তা থেকে রেশমসুতা কী করে পাওয়া যায়, বিপন্ন ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পকে কী করে আবার জাগিয়ে তুলতে হয়, কী করে সবজিচাষ করতে হয় ও মাছ উৎপাদন করতে হয় এবং কী করে গরু-মহিষ পালন করতে হয় সেগুলো নিজেও শিখে নিয়েছিলেন। ব্র্যাক যখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হলো তখন তিনি হয়ে গেলেন ভুট্টা উৎপাদন বিশেষজ্ঞ। হাইতির ভূমিকম্পের পর ব্র্যাক যখন সেখানে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ আরম্ভ করল তখন তিনি প্রকৃত অর্থে একজন কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন।

আমিনভাই সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা বা আদর্শ বিষয়ে খুব বেশি কথা বলার মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সত্যিকারে একজন বাস্তববাদী, বাস্তবমুখী মানুষ। সভা-সেমিনারে থাকার চেয়ে মাঠেই কাজ করতে বেশি ভালোবাসতেন। ব্র্র্যাক যতদিন না দেশের বাইরে কার্যক্রম শুরু করেছে ততদিন তিনি খুব কমই দেশের বাইরে গিয়েছেন। কিন্তু ব্র্যাক যখন আন্তর্জাতিক কার্যক্রম শুরু করল অচিরেই তিনি হয়ে উঠলেন ভূপর্যটক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্র্যাকের কর্মসূচি বিস্তারের অভিযানের পুরোধা হয়ে পৃথিবীর দশটি দেশে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন।

দরিদ্র মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র নারীর প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার জন্য আমিনভাইয়ের খ্যাতি ছিল। আফগানিস্তানে যখন ব্র্যাকের কাজ শুরু হলো আমিনভাইকে তখন বলা হলো নারীকর্মী পাওয়া একেবারে অসম্ভব না হলেও যথেষ্ট কঠিন হবে। কিন্তু আমিনভাই এক্ষেত্রে ‘না’ শুনতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। তাঁর নেতৃত্বে ব্র্যাক সেখানে মেয়েদের জন্য সেলাইকেন্দ্র স্থাপন করল। স্থানীয় গ্রামের মুরুব্বিরা কেবল সেলাইকেন্দ্র খোলারই অনুমতি দিয়েছিলেন।

যখন গ্রামের মেয়েরা সেলাইকেন্দ্রে কাজের জন্য এলেন, তাদের জিজ্ঞেস করা হলো উপার্জনমূলক কাজের জন্য তারা ঋণ নেবেন কি না। তারা রাজি হলেন। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারা ঋণ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করবেন কি না। তাতেও তারা ‘হ্যাঁ’ বললেন। ব্র্যাক এখন আফগানিস্তানে সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, যেখানে বহু নারী ঋণগ্রহীতা যেমন আছেন তেমনি সেখানে কাজ করছেন অনেক নারীকর্মীও। আমিনভাইয়ের একটি মৌলিক দিক ছিল দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর মধ্যে একটি গভীর মমত্ব ও স্নেহবোধ কাজ করত। দরিদ্র মানুষ বা অন্যকোনো জনগোষ্ঠী যাদের জন্য তিনি কাজ করতেন বা যাদের মধ্যে তিনি যেতেন, তারা সেই মমত্ব ও স্নেহবোধের প্রতি সাড়া দিতেন। প্রত্যেক মানুষকে বিশেষ করে ব্র্যাককর্মীদের তিনি যে মাপকাঠিতে পরিমাপ করতেন তা হচ্ছে দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের মমত্ববোধ আছে কি না। দরিদ্র মানুষের প্রতি উদাসীনতা বা বৈরী মনোভাব তিনি কোনো অবস্থাতেই সহ্য করতেন না। তিনি ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্রই সুন্দর’ এই ধারণায় বিশ্বাসীদেরও সহ্য করতে পারতেন না। আবেদভাইয়ের মতো আমিনভাইও দরিদ্র মানুষের জন্য গৃহীত যে কোনো কর্মসূচির বিস্তার ঘটাতে হবে বলে বিশ্বাস করতেন।

আমিনভাই ব্র্র্যাক প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছর বাদে বাকি সময়ে গৃহীত সব কর্মসূচির কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। তাঁর অনুপস্থিতি অনুভূত হবে অনেক ক্ষেত্রে অনেকরকমভাবে, যার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্র্যাকে তিনি এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যকরভাবে পরিচালিত ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রতিষ্ঠানের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী যাঁরা তাঁর বাস্তবমুখী দূরদৃষ্টির দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন সমাজ ও গোষ্ঠীর বহু সমস্যার সমাধান, যা সম্ভব বলে তাঁর আগে কেউ ভাবতে পারেনি, এসবই তাঁর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমিন ভাই

আমিনভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০, ব্র্যাকের শুরুর দিকের পাঁচ বছর আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। অন্য ব্র্যাককর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জামালপুর ও মানিকগঞ্জে আমরা স্থানীয় নারীদের সংগঠিত করেছিলাম। আমিনভাই ও আমি দলগুলোর নাম রেখেছিলাম ‘শ্রমজীবী মহিলা শক্তি’। দলগুলোর সদস্য নারীরা যাতে গ্রাসাচ্ছাদনভিত্তিক জীবিকা থেকে বেরিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিলাম।

সম্প্রতি কাজ উপলক্ষে আমিনভাইয়ের সঙ্গে দুবার মানিকগঞ্জ যেতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে সেই শুরুর দিকের নারীনেত্রীদের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁদের কাছেই জানলাম আমিনভাই তাঁদের অগ্রণী ভূমিকার কথা কখনোই বিস্মৃত হননি। প্রত্যেক ঈদে তিনি তাঁদের জন্য উপহার নিয়ে আসতেন।

আমরা আপনার অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করব, আমিনভাই। কিন্তু আপনার উত্তরাধিকার প্রবাহমান থাকবে।

 

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : প্রিসিলা রাজ

মার্থা (মার্টি) চেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক, পণ্ডিত এবং সমাজকর্মী। ব্র্যাকের সূচনাপর্বে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জ ও জামালপুর কর্মসূচিতে কর্মরত ছিলেন। সেখানে প্রয়াত আমিনুল আলম ছিলেন তাঁর সহকর্মী। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

3.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments