বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের আইনি সুরক্ষা: ব্র্যাকের একটি সমীক্ষা

September 11, 2018

শারীরিক বা মানসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে বিশ্বে একসময় তেমন সচেতনতা ছিল না বললেই চলে। আজ সেই চিত্রটি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বিশ্বে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা ছড়িয়ে আছেন আমাদের আশেপাশে, আমাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মীদের মাঝে। কখনও তাঁদের শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো সহজেই চোখে পড়ে। দৃষ্টিহীনতা, শরীরের কোনও অঙ্গের অভাব বা স্পষ্ট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা। কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধিতা রয়েছে যা চট করে চোখে পড়ে না বা তা থাকার কারণে ব্যক্তির নিত্যদিনের জীবন খুব বাধাগ্রস্ত হয় না বা আমাদের চারপাশে যে সীমিত কাঠামো বা অবকাঠামো আছে তা দিয়েই তাঁরা কাজ চালিয়ে নিতে পারেন।

শারীরিক বা মানসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে বিশ্বে একসময় তেমন সচেতনতা ছিল না বললেই চলে। আজ সেই চিত্রটি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বিশ্বে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। জাতিসংঘ বিভিন্ন ঘোষণা ও কর্মকাণ্ডে মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যেমন তৈরি করে দিচ্ছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও তেমনি তাদের মনোযোগ ও কাজের পরিধিও ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে। এসব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা তাঁদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ যাতে ঘটাতে পারেন সেই ইতিবাচক পরিবেশটি তৈরি করে দেওয়া।

বাংলাদেশেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতা ধীরে হলেও বাড়ছে। সরকার নানা ধরনের আইনকানুন তৈরি করছে তাঁদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে, বেসরকারি পর্যায়েও অনেক কাজ হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষেরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। তাতে সামিল হচ্ছেন অন্যান্য সচেতন ব্যক্তিরা।

কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক নীতি, আইনকানুন ও কর্মকাণ্ড গ্রহণ করতে হলে সে বিষয়ে পরিসংখ্যানগত চিত্র দরকার হয়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের বিষয়ে জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সংখ্যা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে যা প্রতিফলিত হয়েছে সংস্থাটির ‘প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে বিশ্ব প্রতিবেদন’-এ। ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি এ বিষয়ে বিশ্বের প্রথম প্রতিবেদন। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত ছিল বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতার শিকার। কিন্তু এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১৫ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধিতার শিকার। এদের মধ্যে ২-৪ শতাংশ ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতার কারণে দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এ হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর। ব্যুরোর হিসাবমতে প্রতি হাজারে ৯ জন ব্যক্তি কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। সে হিসাবে দেশের ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫০ জন ব্যক্তি কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব থেকে অনেক অনেক কম। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২ কোটি ৪২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ জন। তবে বাংলাদেশ সরকারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণে একটি শুমারি পরিচালনার পরিকল্পনা আছে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য যেসব আইন ও বিধি ইতিমধ্যে আমাদের দেশে হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:  ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’, ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩’, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা বিধিমালা ২০১৫’ এবং ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা কার্যক্রম’। আমাদের দেশের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সরকারের প্রতিবন্ধী সম্পর্কিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের মূল কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ বিভাগ এবং ব্র্যাক বিশ্ব বিদ্যালয় যৌথভাবে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ বিষয়ে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সমীক্ষার উদ্দেশ্য আইনটি সম্পর্কে একটি নিবিড় পর্যালোচনা উপস্থাপন, এর বিভিন্ন ফাঁক চিহ্নিত করা, আইনটি প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা এবং সুপারিশ উপস্থাপন। এ বছর জুনে সম্পন্ন সমীক্ষাটির গবেষকদলের প্রধান শাহরিয়ার শাহাদাত ও প্রধান গবেষক ব্যারিস্টার প্রজ্ঞা জামান।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য বাংলাদেশের আইন ও বিধিগুলো করা হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদের আলোকে। জাতিসংঘে সনদটি গৃহীত হয়েছে ২০০৬ সালে এবং বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করে ২০০৭ সালে। বাংলাদেশের আইনটিতে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন বাধা নিরসন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিকশিত হওয়ার আইনি পরিকাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে।

আইনটির মোট ৪০টি অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংজ্ঞা, প্রতিবন্ধিতার বিভিন্ন প্রকার, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও আইন বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে পরিষদ গঠন, জনপরিসর ও গণপরিবহনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি, শিক্ষার সুযোগ, চাকরি ও জীবিকা অর্জনের অধিকার ও সুযোগ, বৈষম্য নিরসন, অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন প্রয়োগসহ এ সংক্রান্ত প্রায় সব বিষয়ের আইনগত পরিসর ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে।

সমীক্ষাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আইনটিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনসিদ্ধ অধিকারগুলো বাস্তবায়ন কীভাবে হবে তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব আছে। আইনটিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংজ্ঞা আরো সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আইনটিতে সর্বজনীন নকশা সম্বলিত পণ্য ও সেবার কথা বলা হয়েছে যাতে প্রতিবন্ধী নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি এসব পণ্য ও সেবা গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু আইনের এই নির্দেশনা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তার প্রক্রিয়া পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি। আইনে উল্লিখিত গণপরিবহনে ৫ শতাংশ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যার তুলনায় আরো বেশি আসন সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন বলে সমীক্ষাটির মত। আইনটিতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িতদের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তবে সমীক্ষাটির সুপারিশ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জড়িত হতে পারেন এমন সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে আইনটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বয়সসীমা শিথিল করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু শিক্ষা শেষ করার সময়সীমা বাড়ানোর ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ডিগ্রি শেষ করার জন্য যে সময়সীমা দেওয়া হয় সমীক্ষাটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্ন পরিষদ ও কমিটিতে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে ব্র্যাকের এই সমীক্ষাটিতে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments