জমিলা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। এই কান্না রাগে-দুঃখের, অপমানের। মায়ের কান্না দেখে শিশুকন্যারা নির্বাক। তারা ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে জমিলা মেয়েদের সাথেই রাগারাগি শুরু করলেন। যেন সব দোষ তাদের!
“আমার জবান এই তালাক মাইনা নিল, কিন্তু আমার জান মানে নাই। সংসারের ঘানি টাইনা এই জীবন নষ্ট করছি। ঘরের সব কাম এই একা হাতে করছি। ধানের বস্তা টাইনা আমার কোমর আইজ অকেজো। দুই মাইয়ার দেখাশোনা করছি। জীবনটা শেষ কইরা দিছি সংসারের মায়ায় আর এখন সে তালাক চায়! আমার সারাজীবন, দুই মাইয়ার দাম মাত্র চাইর লাখ টাকা!”
-জমিলা
এই বলে জমিলা (ছদ্মনাম) চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে ক্রোধে রক্তবর্ণ ধারণ করা জমিলার মুখ মুহূর্তেই বিবর্ণ হয়ে যায়। দেখে মনে হয়, কোথাও একটা কিছু হারিয়ে গেছে। বিকল্প বিরোধ মীমাংসায় চলতে থাকা কোনো আলোচনাই যেন সে শুনছে না।
জমিলার স্বামী টিটু মিয়া (ছদ্মনাম) প্রবাসী। সন্তান লালনপালনে সংসারের মাঝেমাঝে খরচ দেওয়া ছাড়া তাকে আর কিছুই করতে হয়নি। তাছাড়া পরপর দুই কন্যা হওয়ার টিটুর সংসারের প্রতি মনোযোগও ছিল না। এখন জমিলা সংসার করতে চাইলেও টিটুর তাতে আগ্রহ নেই। ঠিক করে ফেলেছেন তাকে যেভাবেই হোক তালাক দেবেন। দেনমোহর ও ভরণপোষণ বাবদ হিসাবের চার লাখ টাকা দিয়ে সব মিটমাট করতেও প্রস্তুত তিনি।
জমিলা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। এই কান্না রাগে-দুঃখের, অপমানের। তিনি তালাক মেনে নিতে পারছেন না। মায়ের কান্না দেখে শিশুকন্যারা নির্বাক। তারা বুঝে উঠতে পারছে না কী করা উচিৎ। ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে জমিলা মেয়েদের সাথেই রাগারাগি শুরু করলেন। যেন সব দোষ তাদের! বিষণ্ন মুখে মেয়েরা বাইরে চলে যায়। দু’ পক্ষের আলোচনা চলতে থাকে।
জমিলার বিয়ে হয়েছিল পনেরো-ষোলো বছর বয়সে। এরপর সংসারে কেটে গেছে আরো তেরো-চৌদ্দ বছর। এই অল্প বয়সেই সংসারের সব দায়দায়িত্ব সামলিয়ে আজ তিনি ক্লান্ত। পড়ালেখা করার সুযোগ মেলেনি তার। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে দুই মেয়েকে নিয়ে কীভাবে তার দিন চলবে তা ভেবে তিনি নিরুপায়।
আমাদের সমাজে জমিলার মতো এমন অনেকে আছেন যাদের অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় ২ হাজার ৩০১ জন অর্থাৎ মাসের হিসাবে প্রতি মাসে ২৮৮ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে।
এর বাইরেও হয়তো আরও অনেককে এরকম অনিশ্চিত ও অনিরাপদ জীবন বয়ে বেড়াতে হয় সে খবর পত্রিকার পাতায় আসে না। যুগের পর যুগ ধরে শুধুমাত্র বাল্যবিয়ের কারণেই এভাবে বহু নারীকে পারিবারিক নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়।
আধুনিক পৃথিবীতে দিন বদলেছে। সুযোগ পেলে নারীরাও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ আঠারোর আগে বিয়ে হওয়া একজন মেয়েকে যে পরিবর্তিত জীবনের সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খেতে হয়, তা এ সমাজ বোঝে না।
বাল্যবিয়ে জেন্ডারভিত্তিক নিপীড়নের এক অন্যন্য উদাহরণ। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে সকলকে এর ভয়াবহতা বুঝতে হবে। অপরাধ বন্ধে আইন যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেয়া।
ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে মানুষকে মানবাধিকার ও আইনি শিক্ষা বিষয়ক তথ্যের আওতায় নিয়ে এসেছে। এছাড়াও ব্র্যাকের কমিউনিটি রেডিও পল্লীকণ্ঠ ও গণনাটকের মাধ্যমে ৪৭ মিলিয়ন মানুষকে যৌতুক, বাল্যবিয়ে, পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কিত আইন ও প্রতিরোধের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
নারী ও পুরুষের মধ্যে সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে আমাদের অগ্রযাত্রা সফল হোক।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন