বদলে যাওয়া কর্মক্ষেত্র ও কর্মীর সুরক্ষা: ২য় পর্ব

July 27, 2020

ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশমুখেই রাখা হয়েছে জীবাণুনাশক গালিচা। যার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেই জুতা জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে। অফিসের যারা প্রবেশ করবেন তাদের প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে সর্বদা উপস্থিত আছেন সুরক্ষাকর্মীরা।

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব কিছু বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। গত তিন-চার মাসে অন্তত এ বিষয়টি বুঝে গেছে বাংলাদেশের মানুষ।

করোনাভাইরাসকে ভয় করলে চলবে না। আবার অসতর্ক থেকে জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলারও সুযোগ নেই। ‘নিউ নরমাল’ যুগে কাজের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন বাস্তবতা, নতুন পরিবেশ। তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রয়োজন হবে উদ্ভাবনী মনোভাব এবং নতুন-নতুন পদ্ধতির। আর সেই পদ্ধতিগুলো খুঁজে বের করতে হবে সম্মিলিতভাবেই।

প্রতিনিয়ত বাস্তবতাকে বুঝে করোনাকে জয় করার উপায় বের করতে হবে আমাদেরকেই। পুরো বিশ্বই সে চেষ্টা করছে, বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু সরকার বা ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে স্ব-স্ব মহিমায়।

ব্র্যাকের হেড অব সিকিউরিটি মেসবাহ-উন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো নতুন বাস্তবতায় অফিস কার্যক্রম শুরুর জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো।

রোটেশনাল ডিউটি

প্রতিটি ফ্লোরের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনা করে কাজের সময় সর্বোচ্চ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চালু করা হয়েছে রোটেশনাল ডিউটি। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান কার্যালয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কর্মীর উপস্থিতি কমিয়ে রোটেশন ভাগ করে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর্মী একদিনে অফিসে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাতে কাজ করার সময় কর্মীরা কোনোভাবেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে না পড়েন। বাকি ৭৫ শতাংশ কর্মী বাসা থেকে নিয়মিত কাজ করে যাবেন।

এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক কর্মীরা ছাড়া অন্যরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ তিন দিন অফিসে আসতে পারবেন। এ লক্ষ্যে অফিস শুরুর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রত্যেক কর্মীর মতামতের ভিত্তিতে প্রোগ্রামগুলো নিজেদের ডিউটি রোস্টার তৈরি করে। এছাড়া যাদের বয়স ৫০-এর ওপরে অথবা কোভিড-১৯ এর লক্ষণ আছে, শিশুকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন—এমন মায়েরা বা বাসা লকডাউন এলাকার মধ্যে এমন কর্মীরা অফিসে না গিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন আগের নিয়মেই।

ট্রান্সপোর্ট

কোনো কর্মীকে অফিসে আসতে যেন গণপরিবহণ ব্যবহার করতে না হয়, এজন্য আগেই অনলাইন জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে কারা অফিস ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করবেন আর কারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অফিসে আসতে চান। সেক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির চালককে আগেই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

ব্যবহারকারীদের জন্যও তৈরি করা হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। যেমন, গাড়িতে উঠে প্রত্যেককে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। গাড়ির ভেতরে যদি কেউ বসার জায়গা বা অন্য কোথাও স্পর্শ করেন এবং হাত পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়, সেজন্য প্রতিটি গাড়িতে রাখা হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্রতি ট্রিপের পর গাড়ি ধুয়ে-মুছে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সব গাড়ি একই সময় যেন হেড অফিসে এসে না পড়ে সেজন্য আলাদা আলাদা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে; যাতে অফিসের সামনে নামার পর কর্মীরা ভিড় এড়িয়ে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অফিসে প্রবেশ করতে পারে।

ভবনে প্রবেশ

ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশমুখেই রাখা হয়েছে জীবাণুনাশক গালিচা। যার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেই জুতা জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে। অফিসের যারা প্রবেশ করবেন তাদের প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে সর্বদা উপস্থিত আছেন সুরক্ষাকর্মীরা। এই সব নিয়মকানুন মেনে একজন কর্মী লিফটের সামনে পৌঁছবেন।

লিফটের ব্যবহার

স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি লিফটের ধারণক্ষমতা ১৬ জন। কিন্তু এই সময়ে প্রতিবারে লিফটে চার জনের বেশি উঠতে পারবেন না। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য আপাতত কোনো লিফটম্যান থাকছেন না। যারা লিফট ব্যবহার করবেন, তারা লিফটের ফ্লোরে আঁকা চিহ্ন অনুযায়ী দাঁড়াবেন, যেন দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি একে অন্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। প্রতিবার লিফট ব্যবহারের পর সুরক্ষাকর্মীরা লিফটের বাটন ও ফ্লোর ডিজইনফেক্ট করবেন।

ফ্লোরে প্রবেশ

লিফট থেকে নামার পর প্রতি ফ্লোরের প্রবেশ দ্বারে রাখা আছে জীবাণুনাশক ট্রে। যার ওপরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকলে জুতা থেকে জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা আরও কমে যাবে। প্রতিটি ফ্লোরে কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যাতে কিছুক্ষণ পর পর কর্মীরা হাত জীবাণুমুক্ত করে নিতে পারেন।

কর্মীদের জন্য নির্দেশনা

অফিসে প্রত্যেক কর্মী নির্ধারিত স্থানে বসে কাজ করার সময় মাস্ক পরে থাকবেন। নতুন নিয়মকানুন সম্পর্কে কর্মীদের অবগত করতে অনলাইন ওয়ার্কপ্লেসে তৈরি করা হয়েছে নির্দেশনা সংবলিত ভিডিও কনটেন্ট। যা থেকে প্রত্যেকে সুরক্ষা নির্দেশনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। এছাড়া সেন্ট্রাল অডিও সিস্টেমের মাধ্যমে ফ্লোরেগুলোতে প্রতি ঘণ্টায় নির্দেশনাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলা ও ইংরেজিতে প্রচার করা হয়।

সুরক্ষা সামগ্রী

অফিস থেকেই সবার জন্য নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বাধ্যতামূলক সুরক্ষা সামগ্রী।

মিটিং

করোনাকালে কোনো কর্মী অফিসে গেলেও এক জায়গায় অনেকে বসে মিটিং করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজনে ফোনে বা অনলাইনেই মিটিং চলছে নিয়মিতভাবে।

খাবারের ব্যবস্থা

দুপুরে খাবারের জন্য ক্যান্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। ক্যান্টিনের ভিড় কমানোর জন্য খাবার সরবরাহের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে এবং সেখানেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাতে নেওয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা। প্লেটের বদলে ডিসপোজেবল বক্স ব্যবহার করা হচ্ছে খাবার পরিবেশনের জন্য।

খাবারের ধরনের মধ্যেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। রেগুলার খাবার যেমন- ভাত, মাছ, মাংস ও সবজির পাশাপাশি বার্গার, স্যান্ডউইচ-এর মতো ফাস্টফুড সংযোজন করা হয়েছে মেন্যুতে। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কর্মী চাইলে খাবার অর্ডার করতে পারবেন এবং খেতে পারবেন কাজের জায়গাতে বসেই। এজন্য একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কর্মীরা ওয়ার্কপ্লেসে ঢুকে অনলাইনেই খাবারের টোকেন কিনতে পারবেন।

ওয়াশরুম ব্যবহার

কর্মীদের কাজের জায়গায় বসার আগে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসার জন্য নির্দেশনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নিয়মিত সুরক্ষাকর্মীর মাধ্যমে ডিজইনফেক্ট করার পরও ওয়াশরুমগুলোতে রাখা হয়েছে জীবাণুনাশক স্প্রে। যাতে কেউ চাইলে ওয়াশরুম ব্যবহারের আগে ও পরে নিজেই স্প্রে করে সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে নিতে পারেন।

সুরক্ষাকর্মী নিয়োগ

ভবন ও প্রতি ফ্লোরের জন্য রয়েছেন নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত সুরক্ষাকর্মী। যারা প্রতিনিয়ত নিশ্চিত করছেন স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ। কর্মীরা ফ্লোরে বা ভবনে প্রবেশের আগে পরে তো বটেই এমনকি অফিস চলাকালীনও কিছুক্ষণ পরপর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে ডেস্ক, দরজার হাতল, ফ্লোর ও লিফটের বাটন থেকে শুরু করে কর্মীদের সংস্পর্শে আসতে পারে এমন সম্ভাব্য প্রতিটি বস্তু ও স্থান।

মনিটরিং

নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন: প্রতিটি ফ্লোর ও প্রোগ্রামগুলোতে কর্মীদের উপস্থিতি অফিস নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করছে কিনা—তা মনিটর করতে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিদিন স্টাফ অ্যাটেনডেন্স স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয় । এছাড়া অফিস চলাকালীন সময়ে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিধিসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলা হচ্ছে কিনা—সে বিষয়টি সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে রয়েছে একটি বিশেষ সারভেইলেন্স টিম।

বিশেষ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা 

প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য হেড অফিসে সব ধরনের লজিস্টিকের পাশাপাশি ৬০ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত আছে। কোনো কারণে প্রধান কার্যালয়ের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রেড জোন এলাকার মধ্যে পড়ে গেলে ভবনের অপরিহার্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই টিমের থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যবস্থাও প্রধান কার্যালয়ের  ভেতরেই করা হবে।

সরকারি নির্দেশনা

অফিস খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা ও সরকারি বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে কঠোরভাবে। পাশাপাশি ব্র্যাকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দেশীয় বাস্তবতায় উপযোগী বৈশ্বিক চর্চাগুলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

কর্মীর মতামত

কর্মীর মতামতকে প্রাধান্য দিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রণয়নের আগেই অনলাইন জরিপ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ কর্মীর মতামতের ভিত্তিতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নতুন নিয়ম। এমনকি খাবারের মেন্যু নির্ধারণের মতো ছোটো-ছোটো সিদ্ধান্তগুলোর জন্যও কর্মীদের মতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

 

সম্পাদনাঃ সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা

4 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments