বদলে যাওয়া কর্মক্ষেত্র ও কর্মীর সুরক্ষা: ১ম পর্ব

July 26, 2020

“প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিয়মিতভাবে সাজাতে হবে কর্মপরিকল্পনা। একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর—সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য ঠিক করতে হবে নতুন কর্মপদ্ধতি। একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হচ্ছে মানবসম্পদ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই কর্মীদের নিরাপত্তা এবং তাঁদের মনোভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখেও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।”

১৯শে মার্চ ২০২০, সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। স্থান ৭৫ মহাখালী, ঢাকা। ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে থেমে থাকা যানবাহনগুলো থেকে নামছেন কর্মীরা। লিফটগুলোর সামনে লম্বা লাইন। কেউ কেউ বাইরের প্লাজায় অপেক্ষা করছেন, কখন ভিড়টা একটু কমবে। সকাল ১০টা নাগাদ প্রায় দেড় হাজার কর্মীর কর্মব্যস্ততায় মুখর হয়ে উঠল ২০তলা ভবনের প্রতিটি তলা।

রবি থেকে বৃহস্পতি—প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের চিত্র।

বছরের পর বছর ধরে চলা এই দৃশ্যপটে হঠাৎ পরিবর্তন আসে গত ২২শে মার্চ ২০২০ তারিখ। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার সকালে ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়ের সামনে অন্যান্য দিনের মতো কর্মীদের আনাগোনা নেই, নেই যানবাহনের সারি—অদৃশ্য কর্মব্যস্ততা।

কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধান কার্যালয় বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হয় ওই দিন থেকেই।

ঘোষণা আসে ১৭ই মার্চ, বুধবার। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আসার আরও আগে থেকেই নতুন বাস্তবতাকে মানিয়ে কাজ করে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছিল পুরোদমে। আর তাই কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একমুহূর্তও বিলম্ব হয়নি। এমনকি সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগেই ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মীরা নিরাপদে ঘরে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।

কিন্তু যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকাই যে সংস্থার প্রধান কাজ, তারা তো আর ঘরে বসে থাকতে পারেন না।

মানুষের জন্য মাঠেই ছিলেন ব্র্যাকের প্রথম সারির সৈনিকেরা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্র্যাকের অফিসগুলোর কার্যক্রম চালু ছিল পুরোটা সময়জুড়ে। তবে সেখানেও প্রতিটি কর্মীর বয়স ও স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগেই পাঠানো হয় সুরক্ষা সামগ্রী ও নির্দেশনা। কিন্তু প্রধান কার্যালয়ে যেহেতু একসঙ্গে অনেক মানুষ কাজ করেন, তাই ওই সময় তা খোলা রাখা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

তাহলে প্রধান কার্যালয়ের কাজ কি এ সময়টাতে বন্ধ ছিল?

বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থার এত বড়ো কর্মযজ্ঞ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ রাখা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। তাই হেড অফিস বন্ধ রেখেও যাতে সকল কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যায়—সেই প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই।

ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ঘরে বসে কাজ করার বিষয়টি কর্মীদের মাঝে গড়ে তোলাই শুধু নয়; পুরো সময়জুড়ে নিয়মিত পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ব্র্যাকের পক্ষ থেকে। কোনো কর্মী বা তার পরিবারের সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বা উপসর্গ দেখা দিলে তাদের জন্য টেলিমেডিসিনের পাশাপাশি ছিল করোনা পরীক্ষার আলাদা ব্যবস্থা। আর মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য ব্র্যাকের নিজস্ব সাইকোলজিস্ট দলের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় ‘মনের যত্ন মোবাইলে’ নামে একটি টেলিসেবা প্ল্যাটফর্ম।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অফিস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জোরেসোরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগ। এক্ষেত্রে তারা মোটাদাগে পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করেছিলেন নতুন কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য।

১. আলোচনা: পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রধান কার্যালয় বন্ধ থাকলেও প্রতিদিনই পরিস্থিতির সবশেষ অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন দলগতভাবে। করোনা সংক্রমণে সামনের সারির দেশগুলোর অভিজ্ঞতার দিকে নজর রেখে পর্যালোচনা করেছেন দেশীয় বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেন। খোলামনে নিজেদের মধ্যে সেসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা চালিয়ে গেছেন।

২. সমস্যা নির্ধারণ: সার্বক্ষণিকভাবে সুচারু বিশ্লেষণের পর নির্ধারণ করেছেন দেশের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সময়ের আগেই উদ্ভূত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টায় নজরদারি করা হয়েছে সব সময়। প্রতিটি সমস্যাকে ডকুমেন্টেশনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের দেশগুলো তা সমাধানে কী কী উপায় অবলম্বন করছে তা খুব গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সমস্যা চিহ্নিত করার পর সমাধানের উপায় খোঁজা হয়েছে। এক্ষেত্রে অনলাইন জরিপ করে কর্মীদের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামের সমন্বয়ে গঠিত ক্রসফাংশনাল কমিটির মাধ্যমে সমাধানের জন্য গ্রহণ করা হয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত।

৪. বাস্তবায়ন: যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে রিহার্সালের মাধ্যমে তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে আসলেই বাস্তবায়ন যোগ্য কি না।

৫. পর্যালোচনা: সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে তো বটেই, বাস্তবায়নের পরও বারবার গৃহীত সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। প্রতিটি নতুন বিষয়ের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করতে মনিটরিং টুলস, অনলাইন সার্ভে ও সরাসরি মতামত গ্রহণসহ অবলম্বন করা হয় বিভিন্ন পন্থা।

৫ই জুলাই থেকে ব্র্যাক হেড অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি সুচারুভাবে বিশ্লেষণের পর নতুন পৃথিবীর জন্য নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে পরিচালন ব্যবস্থা। যথারীতি কর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, গত চার মাসের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন— এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে নতুন বাস্তবতাতে এসে এখনো পর্যন্ত বড়ো কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। পাশাপাশি সরকারি নির্দেশনা শতভাগ মেনেই প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।

প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বিশ্বের ও দেশের সার্বিক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। ইমেইলের মাধ্যমে সিচ্যুয়েশন রিপোর্ট নিয়মিত সরবরাহ করা হয়েছে কর্মীদেরকে। অভ্যন্তরীণ জরিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মীদের চাহিদা, সমস্যা ও সমাধানের উপায় চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক কাজে নিয়জিত যেসব কর্মীদের শারীরিক উপস্থিতি জরুরি, তাদের জন্য অফিসের নিজস্ব যানবাহন থেকে শুরু করে ছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ব্র্যাকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তারা নিয়মিত লাইভ ভিডিও স্ট্রিমের মাধ্যমে কর্মীদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, খোলা মনে দিয়েছেন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর।

দীর্ঘ সাড়ে তিন মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কর্মীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাতে সার্বিকভাবে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয় কিছু ক্ষেত্রে বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রে আবার কমেছেও। পাশাপাশি প্রধান কার্যালয় বন্ধ রেখে কর্মীদেরকে ঘরে থেকে কাজ করতে অভ্যস্ত করানোর প্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে কাজের পরিমাণ বা মান কোনোটাতেই খুব একটা ঘাটতি দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিয়মিতভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য ঠিক করা হয়েছে নতুন কর্মপদ্ধতি। একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হচ্ছে মানবসম্পদ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই কর্মীদের নিরাপত্তা এবং তাদের মনোভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য নিশ্চিত করার।’

 

লেখার ২য় পর্বে ব্র্যাকের হেড অব সিকিউরিটি মেসবাহ-উন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তুলে ধরা হবে নতুন বাস্তবতায় অফিস কার্যক্রম শুরুর জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো। 

 

সম্পাদনাঃ সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা

4.8 6 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments