একটি বাড়ির রোদ ঝলমলে উঠোনে গ্রামবাসীরা এসে জড়ো হয়েছে। কথার পিঠে কথা চলছে। সাথে চলছে স্মৃতির ভেলা। কেউ কেউ শৈশবে মা-বাবার ঘর থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে আসার পর জীবনের নানা বাঁক বদলের গল্প বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কথা বলার সময় কারও চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কেউ আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ। পিচঢালা মহাসড়কের দুপাশের ঢালু জমিতে সারিসারি আম গাছ। নয়া মুকুলের গন্ধে ম-ম করছে। কোনো কোনো গাছে ছোট ছোট আম ঝুলছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সব গাছের শাখা-প্রশাখা জুড়ে ঝুলে থাকতে দেখা যাবে নানা জাতের আম। আম্রপালি, ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষণভোগসহ আরও কত কী! দূরদুরান্ত থেকে ট্রাক নিয়ে ছুটে আসবে বেপারিরা। বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে দেশের নানা প্রান্তে। সে এক হুলুস্থূল ব্যাপার।
মহাসড়ক ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে। গন্তব্য ভোলাহাট উপজেলার কাশ্মীরপাড়া। যাওয়ার পথে সহকর্মী আতিকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি জানালেন, আমের মৌসুমে নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিয়ের হার অনেক বেড়ে যায়। আর এগুলোর অধিকাংশই বাল্যবিয়ে।
কিছুক্ষণ পর আমরা কাশ্মীরপাড়ায় পৌঁছলাম। একটি বাড়ির রোদ ঝলমলে উঠোনে গ্রামবাসীরা এসে জড়ো হয়েছে। কথার পিঠে কথা চলছে। সাথে চলছে স্মৃতির ভেলা। কেউ কেউ শৈশবে মা-বাবার ঘর থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে আসার পর জীবনের নানা বাঁক বদলের গল্প বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কথা বলার সময় কারও চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কেউ আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।
জানতে চাইলাম, নিজের এত দীর্ঘশ্বাস তবু কেন আমরা মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়ে দেই?
জানলাম, দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এ অঞ্চলে বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ প্রযুক্তিভীতি। অভিভাবকদের অনেকেই মনে করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করার সময় ছেলেমেয়েরা যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, অসাবধানতাবশত ব্যক্তিগত কোনো ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে মেয়ের, তখন তো কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। এই ভয়ে অভিভাবকেরা দ্রুত তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চান।
অথচ বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনে প্রযুক্তির অবদানকে আমরা কীভাবে অস্বীকার করি? বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ এখন দূরদিগন্তের সাথে দূরত্ব ঘোচানোর সাঁকো। ঘরে বসেই বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে, লেখাপড়া সংক্রান্ত যেকোনো সহায়তা পেতে, চিকিৎসকের সেবা নিতে, আইনি সহায়তা পেতে, পণ্য কেনাবেচা করতে এবং বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এখন হয়ে উঠেছে অপরিহার্য মাধ্যম। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের দেশের অসংখ্য নারী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা।
এই ফিল্ড ভিজিট চলাকালে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে ১২ বছরের রত্মার (ছদ্মনাম) বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। পল্লীসমাজের সদস্যরা রত্মার বাবাকে বোঝাতে গেলে তিনি অভাবের দোহাই দেন। সঙ্গেসঙ্গে তারা ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি (সেলপ)-এর কর্মী ওমর ফারুককে মোবাইলে ঘটনাটি জানান। ওমর ফারুক তখনই উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন করে বাল্যবিয়ের বিষয়টি অবহিত করেন। নিজেও ছুটে যান ঘটনাস্থলে। বিয়ে বন্ধ করা হয়। রত্না বেঁচে যায় বাল্যবিয়ের হাত থেকে। কর্তৃপক্ষ বাল্যবিয়ে দেওয়ার অপরাধে বিয়ের ঘটককে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং বরপক্ষের অভিভাবককে দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করে। এসব সম্ভব হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় দ্রুত যোগাযোগ করতে পারার জন্য।
আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে প্রযুক্তিভীতি দূর করে, আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে সবার জন্য একটি নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিত করতে।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন
Very nice article Didi .
Thanks a lot.
সময় উপযোগী
The thought that brings the reality to life through beautiful words is truly remarkable.
Thanks a lot.