নদী ভাঙন মানে তো সবই চলে গেল! হঠাৎ ভিটাবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ প্রথমে বুঝেই পায় না কী করতে হবে? সাধারণত উদ্বাস্তু মানুষ জীবিকার খোঁজে পাড়ি দেয় নতুন কোনো দূর গন্তব্যে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু হয় তাদের নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম।
“তিন নাতি-নাতিনের মধ্যে একজনের জন্ম শুভগ্রামে, একজনের বৈশাখি পাড়ায় আর একজনের জন্ম এই বাড়িতে।’’
– শাহনাজ বেগম
শাহনাজ বেগমের বেড়ে ওঠা শরীয়তপুর জেলার নদী ভাঙন পীড়িত নড়িয়া উপজেলায়। এ পর্যন্ত ছয়বার তিনি ভাঙনের কবলে পড়েছেন। প্রতিবারই ভিটেমাটি হারিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে হয় তিনি আশ্রয় নিয়েছেন কোনো আত্মীয়ের বাসায় অথবা কখনও ছোট একটি ঘর তুলে থেকেছেন পরিচিত কারও উঠানে। শাহনাজ বেগমের বসতভিটা যে কতবার বদলেছে তা তার কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী। দেখা যায়, নদীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় এদেশের মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখের গল্পগাথা।
শাহনাজ বেগমের বিয়ে হয় নড়িয়ার দরিদ্র এক পরিবারে। শ্বশুর-শাশুড়িসহ তিনি স্বামীকে নিয়ে থাকতেন ছনের একটি ঘরে। স্বামী যা রোজগার করতেন তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলত না। সংসারের আয়-উন্নতির জন্য তাই শাহনাজ বেগম নিজেই কিছু করার উদ্যোগ নিলেন।
আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। শাহনাজ বেগম মনে মনে ঠিক করলেন তিনি ছাগল পালন করবেন। ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে এক হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হলো তার নতুন কিছু করার সংগ্রাম। সেই টাকা দিয়ে তিনি একটি ছাগল কেনেন। পরবর্তীতে ঐ একটি ছাগল থেকে পালাক্রমে আরো ছাগলের বাচ্চা হয়। ধীরে ধীরে তার খামার বড় হতে থাকে। ছাগল বিক্রি করে যা আয় করতেন তার কিছুটা তিনি সংসারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে খরচ করতেন। আর বাকিটা জমিয়ে রাখতেন ভবিষ্যতের জন্য।
এভাবে কিছু টাকা জমিয়ে এবং তার সাথে আরো কিছু টাকা ঋণ নিয়ে শাহনাজ বেগম একটি গাভি কেনেন। সংসারে সচ্ছলতা আসতে শুরু করে। আরও ভালো থাকার আশায় তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকেন।
শাহনাজ বেগমের স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর একটি ঘরে থাকার। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের জমানো টাকায় একটি দোচালা ঘর তোলেন। সবকিছু চলছিল ভালো কিন্তু পদ্মার বিশাল বিশাল ঢেউ হঠাৎই এলোমেলো করে দেয় সব। নদীতে বিলীন হয় শাহনাজ বেগমের বসতভিটা।
নদী ভাঙন মানে তো সবই চলে গেল! হঠাৎ ভিটাবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ প্রথমে বুঝেই পায় না কী করতে হবে? সাধারণত উদ্বাস্তু মানুষ জীবিকার খোঁজে পাড়ি দেয় নতুন কোনো দূর গন্তব্যে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু হয় তাদের নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম।
যারা তা করতে পারে না তারা সাধারণত নদী তীরেই খুঁজে নেয় আশ্রয়। যেমনটি খুঁজে নিয়েছিলেন শাহনাজ বেগম। তার কোনো উপায় ছিল না, যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না, ছিল না যথেষ্ট টাকাপয়সা, সম্পদ।
“একটা ভাঙ্গা দিলেই এক লাখ দেড় লাখ। নতুন ঘর দিতে মিস্তিরিতে সব টাকা লইয়া যায়। এই যে নতুন ঘর দিছি এতে মিস্তিরি শুধু ঘরটা পার্টে পার্টে লাগাইয়া দেওয়া বাবদ সাতাইশ হাজার টাকা নিয়া গ্যাছে। এরপর লোহা, গজাল, কাঠ এগুলান আরও অনেক কিছু কিনন লাগে। সবশেষ এক লাখ দশ হাজার খরচ হইছে এহানে আইছি পরে।’’
এ পর্যন্ত ছয়বার নদী ভাঙনের শিকার শাহনাজে বেগম প্রতিবার সব হারিয়েছেন আবার প্রতিবারই শুরু করেছেন নতুন করে। পরিবারের সকলের মতো তার পাশে সবসময় ছিল ব্র্যাক। আত্মপ্রত্যয়ী শাহনাজ সন্তানদের বড় করেছেন। তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন তার ছেলেরাও আয়রোজগার করে। স্বামী, দুই ছেলে ও তিনিসহ তাদের সংসারে এখন উপার্জনকারীর সংখ্যা চার জন। বড় ছেলেকে বালু টানার গাড়ি কিনে দিয়েছেন। বালুর ব্যবসা করে তার রোজগার ভালোই হয়। ছোট ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। আর তার স্বামী খেতখামার সামলায়। সবকিছু মিলিয়ে নাতি-নাতনিদের সাথে কলরবে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছে তার।
পদ্মার ঢেউ শাহনাজ বেগমের বসতভিটা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, এটি দুঃখজনক। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে আমরা অসহায় কিন্তু শাহনাজ বেগমের জীবনকথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভাঙনের স্রোতে হেরে যায় না অনেকের স্বপ্ন। দৃঢ় মনোবল আর আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে অনেকে ঘুরে দাঁড়ায় বারবার।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা
গল্প সংগ্রহে: সুহৃদ স্বাগত