আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়মনীতি নিয়ে অনেক কথাই বলি, কিন্তু নিজেরাই আবার সন্তানকে প্রথম হবার প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিই।
আমার কন্যা প্রমিতিকে যখন স্কুলে দিই তখন তার বয়স সাড়ে তিন বছর। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করি। তাই আমাদের মনে হয়েছিল সারাদিন বাসায় গৃহসহকারীদের কাছে থাকার চাইতে স্কুলে একটা ভালো পরিবেশে দু ঘণ্টা থাকলে তার সামাজিকীকরণ হবে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারবে, দু-একটা গান বা কবিতা শিখতে পারবে। যা ভাবা তাই কাজ। প্রমিতিকে এলাকার মোটামুটি পরিচিত একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সেই স্কুলে প্রমিতির সঙ্গেই আরেকটি মেয়ে পড়ত। তার মাকে দেখতাম কোলে এক-দেড় বছরের একটি ছেলে শিশুকে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে স্কুলে আসতে। তার চুল সবসময় উশকোখুশকো থাকত। গায়ে বাসায় পড়ার জামা। চেহারায় রাত জাগার স্পষ্ট ছাপ। আমার খুব খারাপ লাগত। ভাবতাম আহা বেচারা, দুই সন্তানকে লালনপালন করতে গিয়ে কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন। নিজের যত্ন নেওয়ার সময়ই পান না। একদিন ঐ আপা এবং আরেকজন অভিভাবকের কথোপকথন কানে ভেসে এল। আপা বলছেন, ‘আচ্ছা, স্কুলের মিস কী পড়ায় তা লিখে দেয় না কেন? তাহলে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেয়েকে একটু পড়াতে পারতাম।’ তার এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুই বাচ্চা নিয়ে এমনিতেই তার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। দিনে এক মিনিট অবসর পান বলেও মনে হয় না। তারপরও সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই!
প্রমিতির স্কুলটাও ছিল বেশ অদ্ভুত। প্রথমদিন ক্লাসে অনেক খেলার জিনিসপত্র রাখা ছিল। পরদিন সেগুলো সব সরিয়ে নিয়ে পড়ানো শুরু হলো। পরবর্তী তিন বছর গাদা গাদা পড়ালেখা চলল। অনেক বাচ্চা প্রাইভেট পড়া শুরু করল। আমরা প্রমিতিকে বাসায় কিছুই পড়াতাম না। শুধু প্রতিদিন একঘণ্টা পড়ার টেবিলে বসার অভ্যাস করালাম। এই সময় সে নিজে নিজে কিছু বাড়ির কাজ করত। আর আমি একদম বেসিক মানে অ, আ পড়াতাম।
বিপত্তি বাধল কেজি টুতে ওঠার পর। সেটা ছিল ঐ স্কুলে তার তৃতীয় বছর। কিছুদিন ধরে প্রমিতি কিছুতেই স্কুলে যেতে চায় না। কান্নাকাটি করে। বলল, মিস বকা দেয়। স্কুলে গেলাম, ম্যাডামদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বলেন, প্রমিতি খুব লক্ষ্মী মেয়ে, শুধু পড়তে চায় না। অনেক গবেষণা করে বুঝতে পারলাম, অন্য বাচ্চারা প্রমিতির চাইতে অনেক বেশি কিছু পারে। তারা শব্দ লিখতে পারে, ছোটো বাক্য এমনকি কবিতাও লিখতে পারে। প্রমিতি এখনও বেসিক-এ আটকে আছে। এখনও উল্টো সাত লেখে। ইংলিশ লেখার সময় ‘বি’ কে ‘ডি’ লেখে। ফলে সে মানসিকভাবে চাপে আছে। পড়া না পারতে পারতে তার মনে ভয় ঢুকে গেছে। মিস অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। অথচ তার ক্লাসে কখনই দশজনের বেশি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখিনি। তিনি চাইলেই প্রমিতির মতো পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীকে একটু আলাদা সময় দিয়ে শিখিয়ে নিতে পারেন কিন্তু সেটা তিনি করেন নি।
অতএব, বুঝতে পারলাম আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আছি তাতে শিশুকে একটি নির্দিষ্ট বয়স না হওয়া পর্যন্ত কোনো লেখাপড়া করাব না এই সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক নাও হতে পারে। উল্টো সেটা শিশুর ওপর মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। দুই সপ্তাহের মিশন নিলাম। একটু একটু করে বেসিক অক্ষর, শব্দ শিখালাম। হাতেনাতে ফলাফল মিলল। প্রতিদিন সকালের কান্নাকাটি বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলের খাতায় দু-একটা স্টার পাওয়া শুরু হলো। তাতেই প্রমিতি বেজায় খুশি!
আমি ব্র্যাকে চাকরি করছি, তাই ব্র্যাক স্কুলে কীভাবে শিশুদের শেখানো হয় তা জানার আগ্রহ হলো। খোঁজ নিয়ে বুঝলাম, ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষার্থীরা একটু ভিন্নভাবে শেখে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা এই স্কুলে লেখাপড়া করে। গ্রাম বা শহরের বস্তি এলাকার সাধারণ ঘর হয় তাদের ক্লাসরুম। শিক্ষিকা একই এলাকার বাসিন্দা। কাজেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক বেশ আন্তরিক। শিক্ষার্থীরা যখন পায়ের স্যান্ডেলগুলো গোলাকারে ফুলের মতো সাজিয়ে ক্লাসরুমে ঢোকে তখনই তারা শিখে নেয় যে, এলোমেলো নয়, জীবনে চাই শৃঙ্খলা, চাই একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা। চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চের যে সাধারণ সজ্জা, সেগুলো কিছুই নেই ব্র্যাক স্কুলে। মেঝেতে চট বিছিয়ে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো করে বসে। কাগজে রংবেরঙের ছবি এঁকে শিক্ষার্থীরাই ক্লাসরুম সাজায়। স্কুলে একজন শিক্ষিকাই ছেলেমেয়েদের বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সব পড়াচ্ছেন। এরই মাঝে কখনও নাচ-গান, কখনও ছবি আঁকা, ছড়া আবৃত্তি সবকিছুই চলছে। সবকিছু মিলিয়ে এ যেন এক আনন্দভুবন।
আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়মনীতি নিয়ে অনেক কথাই বলি, কিন্তু নিজেরাই আবার সন্তানকে প্রথম হবার প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিই। তাই ছোটো শিশুরা আরও ভালো করতে স্কুলের পর কোচিং করে। আমি এটা মানতে পারি না। প্রমিতি এখন স্বনামধন্য একটি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সেখানেও অনেক পড়ার চাপ। কিন্তু আমরা খুব ভালো রেজাল্ট করার জন্য কোচিং করাই না। স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই প্রমিতিকে পড়াই। আমরা চাই তার শৈশব আনন্দময় হোক। তাতে যদি সে লেখাপড়ায় মোটামুটি ফলাফল করে, তাতেও আপত্তি নেই। প্রমিতি প্রচুর খেলাধুলা করে। ছবি আঁকার স্কুলে যায়। বই পড়ে। মোবাইলফোনে গেইমও খেলে। কিছুদিন হলো ‘আলোহা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে। সেখানেও হয়তো ভর্তি করিয়ে দেব। মোদ্দা কথা হলো – পথ পথিক তৈরি করে না, পথিকই তার মতো করে পথ তৈরি করে। এক সময় প্রমিতিকেই ঠিক করতে হবে সে কী করতে চায় – পড়ালেখা, গানবাজনা না কি খেলাধুলা। জীবনটা তার, তাই সিদ্ধান্তও তাকেই নিতে হবে। আমরা শুধু তাকে যতগুলো সম্ভাব্য পথ আছে সেগুলো দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।