নির্ভীক, নিঃস্বার্থ
এক যোদ্ধা

May 28, 2020

লকডাউন ঘোষণার পর প্রথম এক মাস কারওয়ান বাজার এলাকায় সকল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের আসা-যাওয়া ছিল প্রায় বন্ধ। বলতে গেলে, সিজুকা একাই ছিলেন মাঠে। মানুষের জন্য কিছু করার প্রবল তাগিদ তাঁকে ঘরে থাকতে দেয়নি। নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই তা সতর্কতা মেনে বেরিয়েছেন পথে। বিশেষ করে তখন সামনে ছিল রমজান মাস। মাঠে না থাকলে বাজারে প্যাকেটজাত দুধের ঘাটতি দেখা দিত।

করোনাভাইরাসকালীন এই দুর্যোগে আমাদের হিরো বা আদর্শ কারা?

উত্তরটা খুব সহজ। ডাক্তার-নার্স, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, সাংবাদিক অথবা ব্যাংক-প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যাঁরা নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে, দায়িত্বপালন করে যাচ্ছেন। সামনের সারির যোদ্ধা তো তাঁরাই। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁদের সাহসিকতার গল্পগুলো দেখে চোখে আনন্দাশ্রু আসে; শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়।

কিন্তু আরও একদল মানুষ আছেন, যাঁরা একেবারে শুরু থেকেই করোনা মহামারির এই যুদ্ধটা সামনে থেকে লড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাজগুলো চোখে পড়ে যেমন কম, গল্পগুলোও থাকে অজানা। খবরের শিরোনাম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইম-লাইন; কোনো জায়গাতেই তাঁদের বিচরণ নেই বললেই চলে।

যাঁরা মহাবিপদ জেনেও রাস্তায় হেঁটে হেঁটে নিজের কাজটা করে যাচ্ছেন বলেই, শত প্রতিকূলতার মাঝেও আপনার-আমার ঘরে খাবারের সংকট হয়নি। এমনই একজন ভালো মানুষ, মানবতাবাদী এবং নিঃস্বার্থ ব্র্যাককর্মী এঞ্জেলা সিজুকা। ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কর্মরত আছেন।

২৬শে মার্চ, ২০২০। বাংলাদেশের মানুষ এমন স্বাধীনতা দিবস আগে কখনও দেখেনি। সারাদেশে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি, পাশাপাশি করোনার কারণে বিভিন্ন জায়গায় লকডাউন ঘোষণা। বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল, অফিস-আদালত। বন্ধ হয়ে গেছে বহু পরিবারের রোজগার। পরিবার ও নিজের সুস্থতার স্বার্থে বেশিরভাগ মানুষ থাকছেন ঘরে।

ঠিক সেই সময়, কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না এঞ্জেলা সিজুকা। তাঁর যে কাজের ধরন, তাতে ওই সময়টাতে মাঠে থাকা জরুরি। আবার বাসায় অসুস্থ মা, একইসঙ্গে ডায়াবেটিস এবং কিডনির রোগী। দুশ্চিন্তা তাঁকে নিয়েও। করোনাকালে এ ধরনের মানুষের জীবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ নিয়মিত বাইরে বের হলে বাসার ভেতরে নিরাপদ রাখা কঠিন।

অনেকক্ষণ নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে, পিছু না হটার সিদ্ধান্ত নিলেন সিজুকা। মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস পরে নেমে এলেন রাস্তায়। বাসা থেকে অফিস বেশ দূরে। ছয়-সাত কিলোমিটারের কম হবে না। গণপরিবহন একেবারে বন্ধ, রিকশাও পাওয়া যায় কালে-ভদ্রে।

তবে সিদ্ধান্তে অনড় তিনি। কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে পায়ে হেঁটেই রওনা হলেন অফিসের পথে। শুনসান সড়কে মাঝে-মধ্যে বাতাসে শিস কেটে সাঁইসাঁই করে চলে যাচ্ছে দু-একটা ব্যক্তিগত গাড়ি। রাস্তার দুধারে বন্ধ সাটারের সারি সারি দোকান। দিনের বেলাতেও ভূতুড়ে নীরবতা। মাথার ওপর চোখ রাঙাচ্ছে গ্রীষ্মের সূর্যটা।

প্রায় দেড় ঘণ্টা কালো পিচের উত্তপ্ত সড়ক পাড়ি দিয়ে পৌঁছুলেন অফিসে।

একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে বিভিন্ন দোকানের তালিকা আর মেমো হাতে নেমে পড়লেন কাজে। আবারও রাস্তায়। তখন বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, মার্কেটগুলোর ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। করোনা আতঙ্কে অন্যান্য বেশিরভাগ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা বাজারে আসেননি।সিজুকাকে দেখে দোকানিদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা-

“আপা! আপনি একলা একটা মেয়ে মানুষ, করোনার মধ্যে বাজারে আসছেন কেন?”

লকডাউন ঘোষণার পর প্রথম এক মাস কারওয়ান বাজার এলাকায় সকল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের আসা-যাওয়া ছিল প্রায় বন্ধ। বলতে গেলে, সিজুকা একাই ছিলেন মাঠে। পরে আস্তে আস্তে বাজার-ঘাটে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এলেও, বাড়তে থাকে সংক্রমণের আশঙ্কা।

চাইলে হয়তো শুরুর দিকে অন্যদের মতো তিনিও ঘরে থাকতে পারতেন। মানুষের জন্য কিছু করার প্রবল তাগিদ তাঁকে ঘরে থাকতে দেয়নি। নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই তা সতর্কতা মেনে বেরিয়েছেন পথে। বিশেষ করে তখন সামনে ছিল রমজান মাস। মাঠে না থাকলে বাজারে প্যাকেটজাত দুধের ঘাটতি দেখা দিত, দাম যেত বেড়ে। ন্যায্য মূল্যে মানুষের ঘরে দুধ পৌঁছাত না।

করোনাকালীন এই দুর্যোগে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়লেও সিজুকাদের কারণে খুচরা পর্যায়ে প্যাকেটজাত দুধের দাম এক টাকাও বাড়েনি। সেইসঙ্গে পুরো সময়টাতে বাজার ব্যবস্থা সচল থাকায় আগের দামেই দুধ বিক্রি করতে পেরেছেন গ্রামের ক্ষুদ্র-মাঝারি খামারিরা।

নিজে যে শুধু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন তাই নয়। পরিবারের কেউ যেন তাঁর কারণে বিপদে না পড়েন সেজন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে নিয়েছেন বাড়তি সতর্কতা। মেনে চলেছেন সমস্ত নিয়ম কানুন। এমনকি প্রথমদিন মায়ের বাসা থেকে অফিসে যাওয়ায়, শ্বশুরবাড়ি খুব কাছে হলেও গত দুমাসে একদিনও যাননি সেখানে।

এঞ্জেলা সিজুকার সরল বিশ্বাস, একে অপরের কল্যাণ ও উপকারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে যে মানব সভ্যতা, শত দুর্যোগেও তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মানুষকেই। তাঁর দর্শন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’। আর তাই কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষাই সিজুকাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।

 

সম্পাদনাঃ তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত

5 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Md. Bashir Ullah
Md. Bashir Ullah
3 years ago

Proud to be a colleague of Anzela Sizuka. Really she is brave, hard working staff and example of others.

Oyshi Chowdhury
Oyshi Chowdhury
3 years ago

She placed an outstanding example. We are very proud of her since she was the first female Sales Representative, recruited by me. Wishing her a very bright future ahead!