তিনি সাধারণ,
তবু তিনি জয়ী

November 1, 2022

প্রায় প্রতিদিনই বিকেলবেলা গল্পের আসর বসে উঠোনে। কারও কারও জন্য হয়তো এই আসরই পথ দেখায় ভিন্নভাবে চিন্তা করার অথবা হয়ে ওঠে সংসারের ছোটো-বড়ো সমস্যা সমাধানে সঠিক পরামর্শ পাওয়ার একমাত্র জায়গা। বেশিরভাগ দিন গল্পের আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকেন তাছলিমা বেগম।

মুন্সীগঞ্জের সেলামতি গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে গেলেই চোখে পড়ে একটি বড়ো চৌচালা টিনের বাড়ি। বলা যায়, প্রায় প্রতিদিনই বিকেলবেলা ঐ বাড়ির উঠোনে গল্পের আসর বসে। আশেপাশের বাড়ি থেকে নানাবয়সি নারীরা আসে। একথা-সেকথা নানা কথার ফাঁকে কেউ কেউ তাদের অভিজ্ঞতা বলে, অন্য অনেকে শোনে। জীবনের কত কত গল্প মিশে থাকে সেসব বৈকালিক বৈঠকে। কারও কারও জন্য হয়তো এই আসরই পথ দেখায় ভিন্নভাবে চিন্তা করার। অনেকের কাছে এই আসরই হয়ে যায় সংসারের ছোটো-বড়ো সমস্যা সমাধানে সঠিক পরামর্শ পাওয়ার একমাত্র জায়গা।

তাছলিমা বেগম, বেশিরভাগ দিন গল্পের আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকেন। তার ঝুলিতে আছে অভিজ্ঞতার কথা, হার না মানার গল্প, চেষ্টা আর পরিশ্রমের গল্প। শ্রোতাদের অনেকের জীবনের সাথে গল্পগুলো মিলে যায়, অনেকে মেলাতে চান। তাই তারা আগ্রহ নিয়ে শোনেন।

জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাছলিমা এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো আছেন। অভাবের সংসারে বড়ো হওয়া তাছলিমার বিয়ে হয়েছিল সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে। অন্য আট-দশ জন সাধারণ মানুষের মতোই ছিল তার প্রতিদিনের সংগ্রাম। চাষাবাদ করে স্বামী যা আয় করতেন তা দিয়ে তিনবেলার আহার জোগনো কঠিন ছিল।

স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে কীভাবে সংসারের হাল ধরা যায় তা নিয়ে তাছলিমাই প্রথমে ভাবা শুরু করেছিলেন। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে তিনিই উপায় খুঁজে বের করেছেন। অন্যদের কাছ থেকে শুনেই একদিন তিনি সাহস করে ব্র্যাকের শ্রীনগর শাখা অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখান থেকে কিছু টাকা ঋণ নেন। সে টাকায় মুরগি কিনে পালতে শুরু করেন। সংসারে আয় বাড়ানোর জন্য একটা তো কিছু করা হলো!

তাছলিমার আগ্রহ, দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় দিন দিন মুরগির খামার বড়ো হতে থাকে। ব্যবসায় লাভ তার সাহস বাড়ায়। তিনি আরো বড়ো কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এবার ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে তার সাথে জমানো কিছু টাকা যোগ করে গাভি কেনেন। এক বছরের মধ্যে একটি বাছুর হয়। অনেক যত্নে সেগুলো বড়ো করতে থাকেন তিনি। একসময় পাঁচটি গাভি বিক্রি করে স্বামীকে বিদেশ পাঠান।

স্বামীর বিদেশে যাওয়ায় ব্যাবসা এবং সংসারের কাজ, সেইসাথে দায়িত্ব সবই বেড়ে যায়। একা হাতেই খামার সামলাতে শুরু করেন তাছলিমা। দৃঢ় মনোবল!

প্রবাসী স্বামীর পাঠানো টাকায় তার খামার আরো বড়ো হয়। তিনি যে সে টাকা সেখানেই বিনিয়োগ করেছেন। এরপর অবশ্য তাছলিমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় তিনি তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। এখন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তার ছোটো ছেলে এসএসসি পাস করে এখন সিঙ্গাপুরে চাকরি করে। সেও মাকে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। আর বড়ো ছেলে দেশে জমিজমার দেখাশোনা করে। তাছলিমা ঠিক করেছেন, তার স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে বড়ো ছেলেকেও বাইরে পাঠাবেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে আবার মুরগির খামার, গবাদি পশু আর জমিজমা দেখাশোনা করে বাকি জীবনটা সুখে-শান্তিতে পার করে দিবেন।

তাছলিমার এই গল্প শুনে কেউ যদি আরো ভালোভাবে থাকার কথা ভাবেন, নতুনভাবে জীবনকে দেখার সুযোগ পান তাহলে তো কথাই নেই। আর তিনি তো জানেন, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ, ঋণ, সঞ্চয় ইত্যাদি সেবা নিয়ে ব্র্যাক তো উদ্যোক্তদের পাশে আছে সবসময়। তাই ব্র্যাকের যেকোনো অনুষ্ঠানেই তিনি সানন্দে অংশগ্রহণ করেন এবং খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প শোনান।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
গল্প সংগ্রহে- সুহৃদ স্বাগত

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments