২০২১ সালে রাশেদ আলী বিবিএ (সম্মান) সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছেন। তিনি তার পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।
আমি যদি সেই ভদ্রলোককে কখনও খুঁজে পাই, যিনি আমাকে স্কুলে লেখাপড়া করতে বলেছিলেন, আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন- তাকে বলতে চাই, “আপনিই আমার জীবনের চেঞ্জমেকার।”
আমার কথা বলতে হলে শুরু করতে হবে ছোটোবেলার দিনগুলো থেকে। আমার নানা, তিনি থলেতে পান, সিগারেট, নাড়ু, বিস্কুট, খুরমা, জিলাপি নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতেন। প্রতিদিন মাঠে চলে যেতেন। কৃষকেরা পছন্দের খাবার কিনে নিতেন ধান, গম, ভুট্টা, কলাই, খেসারি, সরিষা ইত্যাদির বিনিময়ে। সেসব বিস্কুটের দু/এক প্যাকেট মাঝেমাঝে আমার হাতে তুলে দিতেন নানা। মাঝে মাঝে থলে থেকে বের করে দিতেন আখ। কখনও আবার কাঁচা ভুট্টা।
সেই ভালোবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত করে আজ তিনি অনেক দূরে।
প্রথমদিন মাঠে খাবার নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বলতে চাই। তখন আমি অনেক ছোটো। একদিন বাবা গেছেন জমিতে ভুট্টা লাগাতে। মা দুপুরে আমাকে ডেকে বললেন, “তোর বাবার জন্যে মাঠে ভাত নিয়ে যেতে হবে।” কাপড়ের একটা পাগড়ি করে আমার মাথায় দিয়ে তার ওপর একটা ভাতের গামলা বসিয়ে দিলেন। মাথায় গামলা এবং হাতে একটা খালি পানির জগ নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে গামলাটা নিচে নামিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পর আবার মাথায় গামলা নিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
এবার জমির সরু আইল দিয়ে হাঁটতে গিয়ে এক পায়ের সাথে আরেক পা লেগে যেতে লাগল। কিন্তু উপায় নেই, আমাকে তো বাবার কাছে যেতেই হবে। যখনই ক্লান্ত হই তখনই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে থাকি। এভাবে বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে প্রায় এক / দেড় কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে অবশেষে বাবার কাছে গেলাম। তারপর জগ নিয়ে ইট ভাটার ওখান থেকে পানি এনে বাবাকে দিলাম। ভাতের গামলা খুলে বাবা তো অবাক, একি! একেবারে খিচুড়ি হয়ে গেছে- আলু, বেগুন, ডাল, মাছ সবগুলো ভাতের সাথে মিশে গেছে। কিছু না বলে বাবা খেতে শুরু করলেন, সাথে আমিও। পুরস্কার হিসেবে বাবা সেদিন বাজার থেকে মিষ্টি এনে খাইয়েছিলেন।
এবার নিশ্চয় আমার সম্পর্কে আপনাদের একটা ধারণা হয়েছে- গ্রামের সাধারণ পরিবারের অতিসাধারণ ছেলে আমি। হ্যাঁ, আমার বাবা একজন দিনমজুর এবং মা একজন গৃহিণী। বাবা অশিক্ষিত, মা খানিক পড়তে পারেন। তাই আমার পড়ালেখা নিয়ে কেউ তেমন ভাবেনি। এরকম একটা জীবন থেকে স্কুলে পড়তে যাওয়ার পেছনের ঘটনাটি বলতে গেলে কাকতালীয়-
একদিন চকলেট কেনার জন্যে দোকানে গিয়েছিলাম। সেখানে বসে ছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন আর আমি অকপটে সেগুলোর উত্তর দিলাম।
ভদ্রলোক: তোমার নাম কী?
আমি: রাশেদ
ভদ্রলোক: তুমি কী কর?
আমি: কিছু করি না।
ভদ্রলোক: কোন ক্লাসে পড়ো?
আমি: পড়ালেখা করি না।
ভদ্রলোক: পড়ালেখা করলে ভালো জামাকাপড় পরতে পারবা, ভালো খাবার খেতে পারবা, ভালো পরিবেশে থাকতে পারবা, গাড়িতে যাতায়াত করতে পারবা।
তিনি আমাকে আরও অনেক কিছুই বুঝিয়েছিলেন যেন আমি স্কুলে ভর্তি হতে উৎসাহিত হই। পরে জেনেছিলাম, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্য ছিলেন।
অচেনা সেই ভদ্রলোকের কথা আমার মনে দাগ কেটে গেল। স্কুলে ভর্তি হবার স্বপ্নটা কিন্তু আমি দেখতে শুরু করলাম। একদিন মাকে গিয়ে বললাম যে, আমি স্কুলে ভর্তি হতে চাই। তিনি পাশের একটি স্কুলে ভর্তির জন্য নিয়েও গেলেন।
আমি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলাম কিন্তু পরে দেখা গেল স্কুলের খরচ জোগানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুদিন পর শুনতে পেলাম, আমাদের বাড়ির অদূরে ব্র্যাক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নিচ্ছে। আমি সেখানে গেলাম।
হাউসনগর ব্র্যাক স্কুলে আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করি। টাকাপয়সা লাগত না, তাই কেউ বাধাও দেয়নি। স্কুল শিক্ষিকা, বিউটি আপা ছিলেন একজন অমায়িক মানুষ। তিনি আমাদের ১/২ ঘণ্টা পর পর গান/কবিতা শোনাতেন। স্কুলে আমাদের নাচ-গানও শেখানো হতো। বিউটি আপা আমাদের গ্রুপে লেখাপড়া করতে শিখিয়েছিলেন। আমি এখনও এর চর্চা করি।
২০০৭ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। বিউটি আপা পরীক্ষার দিনগুলোতে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতেন। সেবার জিপিএ-৫ পেয়ে আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এরপর তিনি আমাদের কয়েকজনকে বিনা পারিশ্রমিকে বেশ কিছুদিন প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন, যেন আমরা বোর্ড বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। বৃত্তি পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়ে আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।
২০০৮ সালে দাদনচক এইচ. এম. উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ভর্তি পরীক্ষায় আমি ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯৭ নম্বর পেয়েছিলাম। সেবার বই কেনার টাকা জোগাড় করতে একটু কষ্ট হয়েছিল। তবে পরের বছরগুলোতে বৃত্তির টাকা পাওয়ায় আর অসুবিধা হয়নি। ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় আমি মানবিক বিভাগে সকল বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। তারপর ২০১৩ সালে রাজশাহী কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম।
রাজশাহী কলেজে ভর্তির পর রাজশাহী গিয়ে কোথায় থাকব, কী খাব, কীভাবে চলব- এসব দুশ্চিন্তার সমাধান করে দিল ব্র্যাকের মেধাবিকাশ বৃত্তি। রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় আমি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম এবং সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এরপর আমি ২০১৫-২০১৬ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হই।
মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষাটা আমার ব্র্যাক থেকে শেখা। কারণ, আমার জীবনে এমনটা বারবারই হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সামাজিক সংগঠন ‘ইচ্ছে’-র কাজের সাথে আমি যুক্ত হই। ‘ইচ্ছে’ একটি স্কুল পরিচালনা করে থাকে। স্কুলটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরের মির্জাপুর এলাকার বস্তির শিশুদের জন্যে। আমরা কয়েকজন মিলে সেই স্কুলে ক্লাস নিতাম। পড়ালেখার প্রয়োজনীয় উপকরণ ( বই, খাতা, কলম, পেন্সিল ইত্যাদি ) কিনে দিতাম। এমনকি শীতে গরম কাপড়, কখনও কখনও খাবারের ব্যবস্থা করার কাজেও টাকা দিয়ে সাহায্য করতাম। এসব খরচ কখনও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিক্রি করে, অথবা পহেলা বৈশাখে স্টলে গামছা, ফুল, ফুলের ক্রাউন, কোমল পানীয় ইত্যাদি বিক্রি করে, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নকশা এঁকে জোগাড় করেছি।
যারা অনেক বাধা পেরিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে আমি রোল মডেল হতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু এলাকার অনেকেই আছেন যারা আমার শিক্ষাজীবন নিয়ে কথা বলেন, অন্যকে উৎসাহিত করেন। আশা করি তাদের জোগানো অনুপ্রেরণা এবং শক্তিতে সামনে আমি আরও বহুদূর যাব, নিজের জীবনকে করে তুলব সুন্দর।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগদ
সহযোগিতা এবং সমন্বয়- ফাহাদ বিন তৌহিদ