গত ২০শে ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় আবেদ ভাইকে। সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত আবেদ ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন।
পশ্চিমে পড়ালেখা করা একজন মানুষ তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে পেছনে ফেলে ফিরে এলেন পূর্বদিকে, নিজের যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমিতে। সবহারানো মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন একটি স্বপ্ন নিয়ে। প্রথমে আবেদ ভাই ভেবেছিলেন কিছুদিন কাজ করলেই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে। ফিরে যাবেন নিজের কর্মজীবনে। এ যেন সাহেবি কেতাদুরস্ত সাচ্ছন্দ্যময় জীবনের সাময়িক বিরতি। কিন্তু তাঁর আর ফেরা হয়ে ওঠেনি।
দরিদ্র মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা, তাদেরকে বুঝে ওঠা, তাদের অধিকার রক্ষার কঠিন সংগ্রামের পথটিকেই তিনি বাকি জীবনে সাথি করে নিলেন। তারপর একে একে কেটে গেল ৪৭ বছর। তাঁর হাত ধরেই ব্র্যাক আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, বঞ্চনামুক্ত বিশ্ব গড়বার সংগ্রামের অন্যতম সহযোদ্ধা।
২০১৯ সাল ব্র্যাককর্মীদের মনে দাগ কেটে গেল। মানুষের জন্য এ বছরও নতুন নতুন উদ্ভাবনা এবং প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে গেছে ব্র্যাক। সাফল্য ও স্বীকৃতির তালিকায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন প্রাপ্তি। তবুও সবকিছুকেই ম্লান করে দেয় আবেদ ভাইয়ের চলে যাওয়ার সংবাদ। গত ২০শে ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় আবেদ ভাইকে। সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত আবেদ ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন।
প্রথম দেখা
‘সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। গীষ্পতি ও রউফ থানায় যাবেন দারোগাসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। এমন সময় হঠাৎ গীষ্পতির নজরে এলো একজন তিরিশোর্ধ্ব কৃশকায় শ্যামবর্ণ যুবক বাইরে দাঁড়িয়ে অফিসের সাইনবোর্ডটি খেয়াল করে দেখছেন। তাঁর মাথায় একরাশ কালো চুল, টাইবাঁধা, খুবই সপ্রতিভ চেহারা।’
ব্র্যাককর্মী গীষ্পতিদা প্রথম সাক্ষাতে আবেদ ভাইকে এমনই দেখেছিলেন। ‘ব্র্যাক উন্নয়নের একটি উপাখ্যান’ বইটিতে উল্লেখ করা আছে এই গল্প। সেই সপ্রতিভতার সাথে যোগ হয়েছিল শান্ত এবং সৌম্যের এক অপূর্ব মিশেল, সেই সাথে তাঁর কৌতূহলী চোখ যেন সারাজীবন খুঁজে ফিরেছে আলোর পথ।
ব্র্যাকের মডেল এবং নোবেল পুরস্কার
২০১৯ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জয়ের আলোচনায় অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম, এসেছে ব্র্যাকের নাম। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণায় ব্র্যাকের দারিদ্র্য দূর করার মডেল নিয়েও ছিল কাজ। বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘ব্র্যাকের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে দারিদ্র্য শুধু একটি সমস্যা নয়, এটি বহুমাত্রিক সমস্যা। কিছু প্রকল্প আছে যার মাধ্যমে অতিদরিদ্রদের জন্য কাজ করা যায়। সমাজর অন্য আরেকটি অংশ আছে যারা তাদের চেয়ে কম দরিদ্র। দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্র্যাক অনেক আলাদা ধরনের প্রোগ্রাম করে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য–শিক্ষাও রয়েছে। তাদের ধারণা আমাদের মতোই। নানা সমস্যার নানা সমাধান আছে।’
ডাচ নাইটহুড পেলেন
দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারী ও শিশুর উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য এলো আরেকটি স্বীকৃতি। গেল বছর আবেদ ভাই নেদারল্যান্ডসের রাজার পক্ষ থেকে নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাব লাভ করেন। এর আগে ২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। এরপর থেকেই তাঁর নামের আগে যুক্ত হয় সম্মানসূচক ‘স্যার’ উপাধি।
এমন বহু পুরস্কার, বহু সম্মাননা পেয়েও স্যার ফজলে হাসান আবেদ রয়ে গেছেন আমাদের আবেদ ভাই হয়ে। অত্যন্ত বিনম্র, ছায়া দেওয়ার জন্য এক বিশাল মহীরূহ হয়ে আমাদের হৃদয়ে।
ইদান প্রাইজ
শিক্ষার আলো গড়ে তুলতে পারে একটি সুন্দর পৃথিবী। আর এই আলো ছড়িয়ে দিতে আবেদ ভাই ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তিন দশকের বেশি সময় ধরে নানা গবেষণার মাধ্যমে শিশুশিক্ষায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ করে চলেছে ব্র্যাক। শিক্ষার উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে শিক্ষাক্ষেত্রের নোবেল পুরস্কার হিসেবে খ্যাত ইদান প্রাইজ পেয়েছেন আমাদের আবেদ ভাই।
আমরা অনেকেই জানি প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরেপড়া শিশুদের লেখাপড়ার দ্বিতীয় সুযোগ নিয়ে এসেছিল ব্র্যাক স্কুল। আমরা কি জানি, কেমন ছিল শুরুর দিনগুলোর সেসব স্কুল? প্রথম আলো-য় প্রকাশিত ‘আমাদের আবেদ ভাই’ শীর্ষক লেখার রাশেদা কে চৌধূরী বলছিলেন এভাবে- ‘সেদিন শাল্লায় ব্র্যাকের ‘উপ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা’(এনএফপিই) কর্মসূচি দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এক গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় একজন শিক্ষক ২৫-৩০টি শিশুকে নিয়ে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রটি পরিচালনা করছেন। এদের বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, আঙিনায় চাটাইয়ে বসে মহানন্দে শিশুরা লেখাপড়া করছে, আশপাশের কয়েকটি বড় গাছে কিছু গরু-ছাগল বাঁধা! আমার সহযাত্রী ব্র্যাকের এক কর্মী বলেন, যেহেতু এসব শিশুকে বাড়ির গবাদিপশুকে মাঠে চরাতে নিয়ে যেতে হয়, সেহেতু তাদের স্কুলে আনতেও নিষেধ করা হয় না! এমনকি কেন্দ্রগুলো ছুটি হয়ে যাওয়ার আগে প্রতিদিন শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জেনে নেন পরের দিন তারা কখন, কোন সময়টাতে পড়তে আসতে চায়। অবাক বিস্ময়ে উপলব্ধি করলাম, কীভাবে ব্র্যাক আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি করে চলেছে!’
প্লে-ল্যাব: আনন্দের সঙ্গে শেখা
আনন্দময় শিক্ষা শিশুদের পড়ালেখার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলে- এমনটাই ভাবতেন আবেদ ভাই। এই ভাবনার বাস্তব রূপ দিতেই ২০১৯ সালে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট ‘প্লে-ল্যাব’ মডেলটি চালু করে। এখানে শিশুরা ছবি আঁকে, গান গায়, খেলতে খেলতে শেখে। দেশ-বিদেশে ব্র্যাক পরিচালিত ৬৬৫টি প্লে-ল্যাবে আনন্দময় শিক্ষার পাঠ নিচ্ছে ১১ হাজার ৫শ শিশু।
আগামীর পথে ব্র্যাক, এসেছে নতুন নেতৃত্ব
আবেদ ভাই সবসময় এগিয়ে গেছেন সবাইকে নিয়ে। সঠিক পথের নির্দেশনায় সামনে থেকেছেন, তবে কাজের ক্ষেত্রে কর্মীদের দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি ছিলেন পেশাদার ও সুশৃঙ্খল পালাবদলে বিশ্বাসী। আর তাই তিনি সময়ের প্রয়োজনে আস্থার সঙ্গে নিজেই রচনা করে গেছেন পালাবদলের গান, ব্র্যাকে এসেছে নতুন নেতৃত্ব। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে আবেদ ভাই ব্র্যাকের চেয়ারপারসনের পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তবে একইসঙ্গে চেয়ার এমিরিটাস হিসেবে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন।
আছে অনুপ্রেরণা, আছে প্রত্যয়
গত সাতচল্লিশ বছর ধরে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই চালিয়ে গেছেন আবেদ ভাই। আগামীতে উন্নয়নের সম্মুখ সমরে হয়তো তিনি থাকবেন না- এটি রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু ৭২-এর তিরিশোর্ধ্ব সেই যুবক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একই সহানুভূতি, সাহস আর অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সুস্থ, সুন্দর ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বপ্নজাল বুনে গেছেন কোটি কোটি মানুষের অন্তরে।
He was a fearless man. We will not forget you.
হ্যাঁ,আমিও গভীর শ্রদ্ধা জানাই আবেদ স্যারের প্রতি,, আমি ক্লাস পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া একজন ছাত্র,, আমি সেই আবেদ ভাইয়ের Brac School এ পড়েছিলাম, এখন আমি একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনাার,, দোয়া করি এই পৃথিবির প্রতিটা দেশেই যেন Brac School হয়, প্রতিটা গ্রামে, প্রতিটা মহল্লায়।
বাংলাদেশে আর তার মহান মানুষ জন্ম নিবে কিনা জানি না। অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর প্রতি।