বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার সহজে হয় না। অপরাধীর প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে নির্যাতিত বা তার পরিবার ও স্বজনরা ধর্ষণের মামলা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পারে না। কিন্তু মানুষ যদি তার কী করণীয় এবং কী করা উচিত হবে না তা জানে, তাহলে নিশ্চয় পরিবর্তন আসবে।
*নাদিয়া বেগমকে রাতের আঁধারে ধর্ষণ করা হয়েছিল। হতবিহ্বল, যন্ত্রণা আর লজ্জায় কুঁকড়ে থাকা নাদিয়া বুঝতে পারছিল না সে কোথায় যাবে, কাকে বলবে, কার কাছে সাহায্য চাইবে? মা-বাবাকে বলতে পারেনি কারণ নির্যাতনকারী তো দূরের কেউ নয়, ছিল তার চাচা। সুতরাং কাউকে কিছু না বলেই সে দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে চলে যায় এক বন্ধুর বাড়ি। সেখানে তিনদিন থাকে কিন্তু তবুও প্রিয় বন্ধুর কাছে বলতে পারেনি। পরে সে বাড়ি ফিরে আসে এবং মা-বাবাকে ঘটনাটি খুলে বলে। এরপর ধর্ষণের ঘটনাটি গোপন রাখতে তারা নাদিয়াকে অখ্যাত এক হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। একসময় মামলাও করা হয় কিন্তু ততদিনে ধর্ষণের আলামত সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
শুধু নাদিয়া নয় অনেকের জীবনেই এই ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশে গড়ে প্রতি ৬ ঘণ্টায় একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির হার সত্যিই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, এ বছর কেবল সেপ্টেম্বর মাসে ২১৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই পরিসংখ্যান গত দশ বছরের যেকোনো মাসের তুলনায় বেশি।
বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় নিপীড়নকারীর মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। এদেশে ধর্ষণকারীর বিচার না হওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকে। এই বিচারহীনতা অনেকাংশেই এড়ানো যায় যদি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর এর করণীয় সম্পর্কে সাধারণ তথ্য সবার জানা থাকে। কখনও কারো সাথে এমন ঘটনা ঘটার পর যদি তিনি আপনাকে ঘটনাটি সম্পর্কে জানান, আপনি কী জানেন সেসময় তাকে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা উচিত?
আমাদের কী কী জানা জরুরি
যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাকে সাহায্য করার বিষয়টি প্রথমেই খেয়াল করুন:
১. ফোন করে জানান: নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটলে জরুরি সহায়তার জন্য হেল্পলাইন ১০৯-এ ফোন করে জানান। এই নম্বর টোল ফ্রি অর্থাৎ এর জন্য কোনো টাকা খরচ হবে না। জরুরি প্রয়োজনে যে কোনো সহায়তার জন্য জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯-এ কল করুন। | |
২. আলামত সংগ্রহ করুন: কাপড় ও চুল অপরাধী শনাক্তকরণের শক্তিশালী প্রমাণ। এগুলো নষ্ট হতে দেবেন না। সেইসঙ্গে যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি মেডিক্যাল পরীক্ষা করানোর আগে যেন গোসল না করেন তা নিশ্চিত করুন। | |
৩. জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভর্তি করুন: উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা প্রাইভেট হাসপাতালে অনেক সময় মেডিক্যাল পরীক্ষা করার উপযুক্ত সরঞ্জাম থাকে না। সুতরাং প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল টেস্ট করা সম্ভব এমন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যান। | |
৪. মামলা দায়ের করুন: নিকটবর্তী থানায় গিয়ে ধর্ষণের মামলা দায়ের করুন। যদি পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে তাহলে সরাসরি আদালতে গিয়ে আর্জি পেশ করুন। আইনি প্রক্রিয়ায় না গিয়ে মীমাংসা করার কোনো চেষ্টা করবেন না। ধর্ষক বা তার প্রতিনিধি কেউ যদি আদালতের বাইরে কোনো সমঝোতা বা মীমাংসা করার চেষ্টা করে তা বেআইনি। যদি অপরাধী নিজে বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দিয়ে ভয় দেখায় বা দেখানোর চেষ্টা করে তাহলে স্থানীয় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলোতে সহায়তা চান। |
যৌন নির্যাতন যেকোনো শারীরিক আঘাতের চাইতে অনেক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যখন কেউ ধর্ষণের শিকার হয় তখন সাধারণত সে ভয়-লজ্জা-আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে তারা বিষণ্ণতায় ভোগে এবং প্রায়ই দেখা যায় তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সুতরাং নির্যাতিত ব্যক্তির মনোবল বৃদ্ধির জন্য মনোরোগ ও আইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি।
বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার সহজে হয় না। অপরাধীর প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে নির্যাতিত বা তার পরিবার ও স্বজনরা ধর্ষণের মামলা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পারে না। কিন্তু মানুষ যদি তার কী করণীয় এবং কী করা উচিত হবে না তা জানে, তাহলে নিশ্চয় পরিবর্তন আসবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গাজীপুর আদালত ১২ বছরের কন্যাকে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করার অপরাধে বাবাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে।
অপরাধী তার কন্যাকে ধর্ষণের ব্যাপারে কথা বলতে নিষেধ করেছিল। যখন শিশুটি পাঁচ মাসের গর্ভবতী হয়ে পড়ল তখন আর সে কথা চাপা রইল না। তাকে সহায়তার জন্য এগিয়ে এলেন প্রতিবেশী রেখা বেগম। এরপর সেই পাষ- বাবা আয়নালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছিল কারণ সেই নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
ধর্ষণের বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ন্যায্য বিচার পেতে সবাইকে শুধু সঠিক দরজায় কড়া নাড়তে হবে। ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের যদি সঠিক তথ্য জানেন তখনই তাকে সাহায্য করতে পারবেন।
গাজীপুরের ঘটনাটি যেন এর সঠিক চিত্রই তুলে ধরেছে-প্রতিবেশী কোথায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে তা জানতেন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সৎ সাহসও তার ছিল। আইনি সহায়তা পেতে যেসব সংস্থা তাকে সাহায্য করতে পারে তিনি তাদের কাছে গিয়েছেন। রেবেকা মামলা দায়ের করার পর থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার এবং ব্র্যাকের প্যানেল আইনজীবী ও আইনি সহায়তা প্রদানকারীগণ যার যার ক্ষেত্র থেকে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেজন্যই ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে।
মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, যদি ভুক্তভোগী ও তার পরিবার সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ভ কাজ এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। জমিসংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা যেতে পারে কিন্তু ধর্ষণের মতো ফৌজদারি মামলা আদালতের বাইরে সমঝোতা করা অবৈধ।
ব্র্যাকের ৪২৩টি আইন সহায়তা কেন্দ্র দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীদের পাশে আছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জানতে পারলে তখনই ব্র্যাকের প্রতিনিধি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ব্র্যাকের প্রতিনিধি ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, আইন ও মনোসামাজিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো, ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ, প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেন। আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবার পর ব্র্যাকের প্যানেল আইনজীবীগণ আদালতে মামলা চালাতে সহায়তা করেন। সেইসঙ্গে ভুক্তভোগীর পক্ষে কথা বলার প্রতিনিধি-জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য ব্র্যাক প্রতিরোধ, সুরক্ষা ও বিচার বিষয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করে।
সরকার, ব্র্যাক ও অন্যান্য সংস্থা এই ধরনের নানা উদ্যোগ পরিচালনা করছে বলেই ধর্ষণের ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে ধর্ষিতাকে ধর্ষকের সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ রয়েছে তা বন্ধ করতেও এই সংস্থাগুলো কাজ করছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী এ বছর নয় মাসে ১,১১৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ৮৪৯টি ক্ষেত্রে ধর্ষকের সংখ্যা ছিল একজন এবং গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৫১টি। ৪৪৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী ছিল তাদের পরিবারের আপনজন। ধর্ষণের মামলা হয়েছে এমন ঘটনাগুলো থেকে এই তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। মামলা হয়নি বলে আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা হয়তো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে পরিচালিত ১৬ দিনব্যাপী প্রচারাভিযানে আসুন আমরা এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করি যে, পরিবার বা বন্ধুপরিজনদের কেউ যদি ধর্ষণের শিকার হয় তা গোপন না করে প্রশাসনকে জানাব এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার লাভে সহায়তা করব।
বিঃদ্রঃ-নাদিয়ার ঘটনাটি সত্য কিন্তু তার আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি