করোনা মানেই মৃত্যু নয়, প্রচার করি সর্বময়

July 6, 2020

মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন প্রায় ২০ হাজার পরিবারের সাথে আমরা সরাসরি কাজ করছি। বৈশ্বিক এই মহামারিতেও থেমে থাকেনি আমাদের পথচলা। যখন লকডাউন চলছিল, অনেকে প্রশ্ন করতেন, সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই ঘরে আছে, আপনারা কেন ফিল্ডে? আমরা বলতাম, নিজেদের কর্মসুচির সাথে সম্পৃক্ত মানুষের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় সচেতনতার বার্তাগুলো সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি আমরা।

সচেতনতায় থাকব বেশ, করোনা হবে নিরুদ্দেশ- এই কথাটিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে করোনা-পরবর্তী আরও সুন্দর ও  বাসযোগ্য পৃথিবীর প্রত্যাশায় শুরু করছি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার গল্প।

আমি ব্র্যাকে যোগদান করি ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে। সেবছর দেশে ভীষণ বন্যা হয়েছিল। বন্যা কবলিত আশ্রয়হীন মানুষের পাশে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে দাঁড়ায় তা দেখে প্রথম দিনেই ব্রাঞ্চ অফিসের কর্মকাণ্ডে বিষ্ময় প্রকাশ করি। তখনই যেন চিনে নিয়েছিলাম, সেরা স্বপ্নদ্রষ্টা মানবতার ফেরিওয়ালা স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও তাঁর ব্র্যাককে।

সেদিনই মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম যাব না কোথাও। তারই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাক ফিশারিজ এন্টারপ্রাইজের একজন কর্মী হিসেবে কুমিল্লায় ব্র্যাক আঞ্চলিক কার্যালয়ে এখনও কর্মরত আছি।

মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন প্রায় ২০ হাজার পরিবারের সাথে আমরা সরাসরি কাজ করছি। বৈশ্বিক এই মহামারিতেও থেমে থাকেনি আমাদের পথচলা। যখন লকডাউন চলছিল, অনেকে প্রশ্ন করতেন, সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই ঘরে আছে, আপনারা কেন ফিল্ডে? আমরা বলতাম,আমরা বলতাম, নিজেদের কর্মসুচির সাথে সম্পৃক্ত মানুষের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় সচেতনতার বার্তাগুলো সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি আমরা।

লকডাউনে হঠাৎ কমে গেল মাছের দাম। যারা মাছ চাষ করেছেন তারা পুকুরের মাছ বিক্রি করতে পারছেন না। তাদের চোখে-মুখে হাতাশার ছাপ স্পষ্ট।  তাদের সাহস জোগানোর জন্য স্মরণ করিয়ে দিই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যচাষিদের অবদানের কথা। বলতাম, হতাশায় ভেঙে পড়লে চলবেনা, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে।

আমার সহকর্মীরা বিভিন্ন সচেতনতা এবং সেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে মৎস্যচাষিদের প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করছেন। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে মাছ। কাজেই সামনের দিনগুলোতে মাছের চাহিদা ক্রমশই বাড়বে- এই ধরনের বিভিন্ন উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে মাছ চাষের ওপর তাদের আস্থা ধরে রেখেছি। এছাড়া মৎস্যচাষিরা যাতে তাদের মাছের ভালো দাম পায় সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন আড়তের সাথে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছি।

অধিকাংশ ব্যাংকের শাখাগুলোর কার্যক্রম তখন প্রায় বন্ধ। আমাদের কাছ থেকে রেণু/পোনা সংগ্রহ করতে পারছিলেন না ইচ্ছুক চাষিরা। চাষিদের পাশে থেকে সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের কর্মসূচির স্বাভাবিক কাজও চালিয়ে যেতে হবে। তাই জরুরি অবস্থায় চাষিদের কাছ থেকে রেণু/পোনার অগ্রিম টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যে হ্যাচারিগুলোতে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলার জন্যে প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাই। কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্রুত ৭টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। এই অ্যাকাউন্টগুলোই এখন অগ্রিম টাকা লেনদেনের প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।

ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে একদিন জাহাঙ্গীর হোসেন নামে একজন মৎস্যচাষি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা মনির ভাই, করোনাভাইরাসের বিষয়ে কেবল হাত ধোয়ার কথা বেশি বলা হয়। একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?” উত্তরে আমি বললাম, “করোনাভাইরাস হচ্ছে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং খুব ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস। এটি নাক, চোখ ও মুখের মাধ্যমেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। হাত দিয়ে আমরা বিভিন্ন জিনিস স্পর্শ করি। তারপর এই হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ করলে আমরা সংক্রমিত হতে পারি। তাই হাত জীবাণুমুক্ত থাকলে আমরাও ভালো থাকি।”

এভাবেই আমরা মুখে মুখে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি । আমি কোটবাড়ি এলাকায় বাস করি। এখানে বড়ো বড়ো মুদি দোকানসহ অন্যান্য দোকান রয়েছে। এলাকাটি জনবহুল হওয়ার কারণে দোকানগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। শারীরিক দুরত্বের বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। একদিন আমি নিজেই বাজার থেকে রং ও তুলি এনে কয়েকজন ব্র্যাককর্মীর সহযোগিতায় প্রতিটি দোকানে শারীরিক দুরত্বের বৃত্ত এঁকে দিই। দোকানদারদের মধ্যে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই চিহ্নগুলোর অর্থ আমি জানি না। দয়া করে আমাকে একটু বলবেন?” আমি তখন প্রশ্নকারীসহ সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, “এই সাংকেতিক চিহ্ন হলো, করোনা রোগের ঝুঁকি কমানোর পদ্ধতি। মানুষ থেকে মানুষের দুরত্ব হবে ১.৮ মিটার (কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ ফুট)। এই দূরত্ব মেনে চললে করোনা সংক্রমণ অনেকটাই কমানো যাবে।”

একথা শুনে সবাই সাংকেতিক চিহ্নের ব্যবহার নিশ্চিত করবেন বলে কথা দিলেন। আরও বললেন, দোকান থেকে কেনাকাটি করার সময় বৃত্ত দেখে দূরে দূরে দাঁড়াবেন

শত বাধা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারও মৎস্যচাষিকে বিনামূল্যে কারিগরি সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সচেতনতামুলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি অর্জনে আমি সদা প্রস্তুত। ব্র্র্যাক ফিসারিজ কর্মসূচির এই ধরনের উদ্যোগকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। এলাকার মানুষের ধারণা ক্রমশই পাল্টাচ্ছে, তারা এখন বুঝতে পারেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সচেতনতা কেন অন্যতম প্রধান শর্ত।

একটি বিষয় উপলব্ধি করা যায়, মানুষের জীবনে মহামারিসহ নানা বিপর্যয়ের শঙ্কা আসতেই পারে। কিন্তু আমরা যদি আত্মপ্রত্যয়ী হই, পরিশ্রম, সততা ও নিষ্ঠার সাথে ধৈর্যসহ একে অন্যের সহযোগিতায় কাজ করি তবে দুঃসময় হবে সাময়িক, সফলতা আসবেই প্রতিটি জীবনে।

 

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Prosanta Kumar dey
Prosanta Kumar dey
3 years ago

ধন্যবাদ মনির ভাই !! মনির ভাই আমি এক অফিসে (কুমিল্লা আরও) আগে পরে দিয়ে সাত বছর কাজ করেছি । আসলেই তিনি একজন মানুষের সেবায় সর্বদা নিবেদিত প্রাণ। বয়সে বড় হলেও কুমিল্লায় তিনি ছিলেন আমার অন্যতম ভরসাস্থল। আবারও ধন্যবাদ ভাই।