আদর গার্মেন্টস

November 24, 2022

পান্না বেগম আর তার স্বামী তাইজুল ইসলাম মিলে গড়ে তুলেছেন এই এক ঘরের গার্মেন্টস। দুজনে মিলে সুন্দর একটা নামও দিয়েছেন তার, ‘আদর গার্মেন্টস’। এখানে সারাদিন চলতে থাকা সেলাই মেশিনের একটানা খট্ খট্ শব্দের সাথে মিশে আছে সম্ভাবনার গল্প, আছে একসাথে ভালো থাকার চেষ্টা।

মুন্সীগঞ্জ সদরের ভট্টাচার্য্যের বাগ গ্রামের একটি দোচালা টিনের ঘরে সকাল সকাল কয়েকজন মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেকেই বাসা থেকে নাশতা সেরে টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে আসেন। ঘরের এক কোনে থান কাপড় স্তূপ করে রাখা। আর চারপাশে সাজানো দশটি সেলাই মেশিনের সামনে বসে দশ জন। পান্না বেগম আর তার স্বামী তাইজুল ইসলাম মিলে গড়ে তুলেছেন এই এক ঘরের গার্মেন্টস। দুজনে মিলে সুন্দর একটা নামও দিয়েছেন তার, ‘আদর গার্মেন্টস’। এখানে সারাদিন চলতে থাকা সেলাই মেশিনের একটানা খট্ খট্ শব্দের সাথে মিশে আছে সম্ভাবনার গল্প, আছে একসাথে ভালো থাকার চেষ্টা।

আদর গার্মেন্টসে ছোটো শিশু ও কিশোরী মেয়েদের জন্য ফুল তোলা ও নকশা করা বিভিন্ন জামাকাপড় তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাজারে তাদের তৈরি করা পোশাকের বেশ কদর আছে। অনেক মেহনত করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন তারা।

পান্না বেগমের স্বামী ছিলেন স্থানীয় এক টেইলার্সের একজন সাধারণ কর্মচারী। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একসময় গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা হয় না। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। অভুক্ত সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে নতুন ব্যাবসা দাঁড় করানোর কথা ভাবলেন।

ব্যাবসা শুরু করার মতো যথেষ্ট টাকা তাদের কাছে ছিল না। পান্না বেগম তখন ব্র্যাকের মুন্সীগঞ্জ সদর শাখা অফিস থেকে ঋণ নেন। সে টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। তাইজুল ইসলামের দর্জির দোকান আর গার্মেন্টসে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা তো ছিলই, পান্না বেগম ছোটোবেলায় মায়ের কাছে কাপড়ে ফুল তোলা শিখেছিলেন। নিজেদের এসব অভিজ্ঞতা পুঁজি করেই দুজন মিলে শুরু করেন শিশু ও কিশোরীদের জন্য তৈরি পোশাকের ব্যাবসা।

তাইজুল ইসলাম বাজার থেকে থান কাপড় কিনে এনে নিজেই বিভিন্ন ডিজাইন করে ফ্রক, স্কার্ট, সালোয়ার-কামিজ তৈরি করতেন। তাতে নিপুণ হাতে নকশা ও ফুল তুলতেন পান্না বেগম। অল্পদিনেই তাদের তৈরি জামাকাপড়ের ভালো চাহিদা তৈরি হয় স্থানীয় বাজারে। পান্না বেগমের সংসারে সচ্ছলতা আসে। ছেলেমেয়েদের মুখে তিনবেলা ভালোমন্দ খাবার তুলে দেওয়ার মতো আনন্দ আর কোথায়!

পান্না বেগম ব্যাবসা শুরুর কিছুদিন পর পুর্বের ঋণ পরিশোধ করে ব্র্যাক থেকে আবার কিছু টাকা ঋণ নেন। আরেকটি সেলাই মেশিন কেনেন। এভাবে ধীরে ধীরে ব্যাবসার পরিধি বাড়তে থাকে। সেলাই মেশিন বাড়তে থাকার কারণে অন্যদেরকে তার দোকানে কাজে নেওয়ার সুযোগ আসে। নিজেদের আয়-রোজগার বাড়ার পাশাপাশি কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হয়। এখন প্রতি মাসে আড়াই লাখের মতো টাকা আয় হয় পোশাক বিক্রি করে। কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাদে বেশ ভালো লাভ থাকে তাদের।

পান্না বেগম দুটি চৌচালা টিনের ঘর তুলেছেন। স্বামী সন্তানদের নিয়ে সেখানেই থাকেন। তিনি শুধু দারিদ্র্য দূর করে নিজে স্বাবলম্বীই হননি, সন্তানদের ভবিষ্যতও গড়ে দিয়েছেন। তার তিন ছেলেকেই পড়ালেখা শিখিয়েছেন। বড়ো ছেলে এখন বিদেশে থাকে। সেখানে কাজ করে সে মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠায়। মেজ ছেলে মুন্সীগঞ্জেরই এক মাদ্রাসায় পড়ায় আর মা-বাবাকে ব্যাবসায় সাহায্য করে। ছোটো ছেলে অনার্সে পড়ালেখা করছে। তার বিশ্বাস যে, ছেলেরা একদিন অনেক ভালো কিছু করবে।

পান্না বেগম একজন সফল উদ্যোক্তা হলেও, তিনি তার অতীত ভুলে যাননি। অনেক সংগ্রামের মাধ্যমে সাতাশ বছর ধরে যে ব্যাবসা দাঁড় করিয়েছেন, তা আরো বড়ো করার ইচ্ছে আছে। এর মাধ্যমে তিনি তার মতো আরও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে চান। ব্র্যাক যেভাবে সাতাশ বছর আগে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, তিনিও তাদের পাশে সবসময় সাধ্যমতো থাকতে চান।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
গল্প সংগ্রহে- সুহৃদ স্বাগত

4.5 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments