কথা ছিল বিয়ের পর স্বামী বিদেশে চলে যাবে। হলোও তাই। প্রথম প্রথম স্বামী বিদেশ থেকে টাকা পাঠাত। তখন সবকিছু ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর হঠাৎ কী হলো সে খরচের টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিল। টাকা ছাড়া আকলিমা একা সব সামলাবেন কীভাবে?
স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, নিজের পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হবেন। কিন্তু নবম শ্রেণিতে ওঠার পর তার মনে হয়েছিল, সে স্বপ্ন বুঝি ভেঙে গেল। কারণ লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া এলাকার রঘুনন্দনহাট গ্রামের বাসিন্দা মোছাম্মত আকলিমা আক্তার।
আকলিমার মনে আছে সেদিনের কথা, একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলেন তার বিয়ের কথা চলছে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ছেলে বিদেশে থাকে, বিয়ে হলে মেয়ের হবে ভাবনাহীন জীবন। তাই পরিবারের কেউই ”বিদেশে থাকা এই সোনার টুকরো ছেলেকে” হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
কথা ছিল বিয়ের পর স্বামী বিদেশে চলে যাবে। হলোও তাই। প্রথম প্রথম স্বামী বিদেশ থেকে টাকা পাঠাত। তখন সবকিছু ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর হঠাৎ কী হলো সে খরচের টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিল। টাকা ছাড়া আকলিমা একা সব সামলাবেন কীভাবে? অভাবের কারণে তিনি ফিরে এলেন বাবার বাড়ি। তখন তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। কিছুদিন পর আকলিমার কোল জুড়ে এলো প্রথম সন্তান, তার ছেলে।
আকলিমা এবার বুঝতে পারলেন, তাকেই কিছু একটা করতে হবে। কাপড় সেলাইয়ের দোকানে কাজ নিলেন তিনি। তবে ভাগ্যের ফেরে কিছুদিন না যেতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিডনির অসুখ, হেলা করার উপায় নেই। চাকরি ছাড়লেন। চিকিৎসায় ব্যয় হলো অনেক টাকা। কয়েকজন নিকটাত্মীয় সেসময় খরচ জুগিয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রতি আজও কৃতজ্ঞ। সেবার নিয়মিত চিকিৎসা আর বিশ্রাম নেওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
সুস্থ হয়েই তিনি আবার সেই দোকানে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শুরু করলেন। কিন্তু সামান্য যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে তো সংসার চলে না। নতুনভাবে ভাবলেন এবার। চাকরি নয়, নিজেই কিছু করবেন। কোনোরকমে কিছু টাকা ধার করে একটি সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে বসে এবার নিজের মতো কাজ শুরু করলেন।
সেলাইয়ের কাজ চলতে লাগল। আয় আগের চাইতে কিছুটা বাড়ল। আকলিমা এবার চিন্তা করলেন বাড়িতে একটি গরুর খামার করবেন। দুই-একজনের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির গ্রাম সংগঠনের সদস্য হলেন। এটি ২০০৭ সালের কথা। সদস্য হয়ে প্রথমে ৭০০০ টাকা ঋণ নিয়ে একটি বাছুর কিনে শুরু করলেন গরু পালন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন গরু পালনে লাভ বেশি।
এরপরের বছরগুলোতে আকলিমা নিয়মিত ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে গরু পালনে বিনিয়োগ করতে থাকেন।
এর মধ্যে আকলিমার মাথায় নতুন আরেক ভাবনা এলো। তিনি আবার ঋণ নিলেন। উদ্দেশ্য আগেরবারের থেকে কিছুটা ভিন্ন। বাড়ির পতিত পুকুরে মাছ চাষ শুরু করা। প্রস্তুতি গ্রহণ করে কাজ শুরু করলেন, ভালোই লাভ হলো। তাই সেলাই এবং গরুপালনের পাশাপাশি এই কাজও চালিয়ে গেলেন।
বছর চারেক আগের কথা। আকলিমা তখন প্রতি বছর প্রায় ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকার গরু বিক্রি করেন। আর অন্যান্য কার্যক্রম থেকে আয় তো আছেই। সেই আয় থেকে বেশ কিছু টাকা তিনি সঞ্চয়ও করেছিলেন। সেই টাকায় চট্টগ্রাম শহরে ছেলেকে একটি ফাস্টফুডের দোকান দিলেন। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই এলো কোভিড-১৯ মহামারি। তাই এই উদ্যোগ থমকে গেল।
মহামারির কারণে সবাই যখন ঘরে বন্দী তখন আকলিমা চাইলেন এই সময়টাকেও কাজে লাগাতে। এবার তিনি মেয়েদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। ফলে একদিকে যেমন গ্রামের মেয়েরা সেলাইয়ে দক্ষতা অর্জন করতে লাগল, অন্যদিকে তাদের আয়ের একটা উপায় হলো। আবার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে বলে তো ছেলেকে বসিয়ে রাখা যায় না। তাই তাকে এবার কাজের জন্য বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। সফলও হলেন।
ছেলে বিদেশে কাজ করছে এবং নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছে। এবার আকলিমা নিজের বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একসময়ের নিঃস্ব, থমকে যাওয়া আকলিমা এখন প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা খরচ করে নিজের বাড়ি নির্মাণ করছেন। বাড়ির পাশের পতিত জমিতে আকলিমা লাউ, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন। এখান থেকে প্রতিমাসে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে ব্র্যাকেই একটি ডিপিএস করেছেন।
আকলিমার জীবন এখন আর থেমে নেই। তিনি ব্যস্ত থাকেন তার সেলাই, সবজি বাগান, মাছ চাষ ও গরু পালনের কাজ নিয়ে। সংসারে সচ্ছলতা তো ফিরেছে আগেই। আত্মবিশ্বাসী আকলিমা তার বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ আর কঠোর পরিশ্রমকে পুঁজি করে আরও বহুদূর যাওয়ার আশা রাখে। তিনি মনে করেন, জীবনে সমস্যা থাকবেই কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সমস্যায় পড়লে তা সমাধানের সব ধরনের উপায় নিয়েই ভাবতে হবে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা ও সাব্বির আহমেদ ইমন
কারিগরি সহযোগিতা: ফুয়াদ রাব্বী শুভ্র