দাদা, আমাদের সুবলদা। শুদ্ধতার শেকড় যিনি স্পর্শ করতে চাইতেন বারবার। যে কোনো শব্দ তিনি বললে অবশ্যই ঠিকটাই বলেছেন, এই বানানের শুদ্ধতা যাচাই করতে অভিধান দেখার প্রয়োজন নেই।
আমি: দাদা, এই লেখাটি একটু দেখে দিন তো।
দাদা: ঠিক আছে, রেখে যান।
আমি: না দাদা, এখুনি দিতে হবে।
দাদা: আচ্ছা দিন।
বরাবরের মতো এবারও তিনি ‘না’ বললেন না। লেখাটি পড়লেন এবং ভুলভ্রান্তিগুলো লালকালি দিয়ে দাগিয়ে ফেরত পাঠালেন। আমি কম্পিউটারে তা কারেকশন করছি। হঠাৎ আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। দাদা তো জানেন, কিন্তু তারপরও ‘শিশু একাডেমী’ বানান ‘শিশু একাডেমি’ লিখেছেন। তক্ষুনি দাঁড়িয়ে-
আমি: দাদা, ‘শিশু একাডেমি’ বানান ভুল। তারা এখনও ‘একাডেমী’ শব্দটিই লেখে।
দাদা: আপনি ভালো করে খুঁজে দেখুন।
আমি: এই যে দেখুন ওয়েবে রয়েছে।
দাদা: তাই না কি?
এবার দাদা যা করলেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি শিশু একাডেমির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে বললেন, ‘এই যে ভাই, আপনাদের ‘একাডেমি’ বানান যে সংশোধন হয়েছে তা তাজনীন সুলতানা মানতে নারাজ। তাকে বুঝিয়ে বলুন।’ এই বলেই ফোনটা আমাকে ধরিয়ে দিলেন।
এই হলো দাদা, আমাদের সুবলদা। শুদ্ধতার শেকড় যিনি স্পর্শ করতে চাইতেন বারবার। যে কোনো শব্দ তিনি বললে অবশ্যই ঠিকটাই বলেছেন, এই বানানের শুদ্ধতা যাচাই করতে অভিধান দেখার প্রয়োজন নেই-এভাবে শুধু আমি যে ভাবি তা নয়, আমার ধারণা তাঁর সঙ্গে যারা কাজ করেছেন সবাই এ বিষয়ে একমত হবেন। বাংলাভাষা সম্পর্কে তাঁর জানার পরিধি নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় আছে বলে মনে হয় না।
দীর্ঘকাল তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে শুনেছি তাঁর কবিতা পাঠ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কতো কতো কবিতা তাঁর ছিল কণ্ঠস্থ। একের পর এক কবিতার লাইনগুলো আওড়ে যেতেন। কীভাবে মুখস্থ করেছেন? উত্তরে ছেলেবেলার একটি অভ্যাসের কথা বলেছিলেন। ছেলেবেলায় তিনি পছন্দের কবিতাটি প্রথমে মুখস্থ করতেন, তারপর গ্রামে পথচলার সময়টায় সেই কবিতাকে সঙ্গী করে নিতেন। তাঁর হিসাবটা ছিল এরকম, এই কয়টি কবিতা পাঠ করতে করতে তিনি এই জায়গা থেকে ওই জায়গায় যাবেন এবং তিনি সত্যিই তা-ই করতেন। এতে না কি পথচলার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে যেত।
দাদা শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসতেন। ভাষার পরিবর্তন এবং আধুনিকতা নিয়েও তাঁর আগ্রহের সীমা ছিল না। এই যে, ‘একাডেমি’ বানানটির কথা বললাম, শুনেছি সম্প্রতি ‘শিশু একাডেমি’ তার ‘একাডেমি’ বানানটি সংশোধন করেছে। প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে বানানটি তাদের ওয়েবসাইটে ঠিক হয়নি। কিন্তু দাদা এ সম্পর্কে জেনে তার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাঁকে হয়তো এতোটা সচেতন করে তুলেছে। স্যালুট দাদা আপনাকে, স্যালুট।
আমি ব্র্যাক থেকে প্রকাশিত শিশুকিশোর মাসিক ‘সাতরং’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। কাজেই শিশুতোষ গল্প-ছড়া-কবিতা ও রচনা নিয়ে ছিল আমার ভুবন। তিনি সবসময় বলতেন, শিশুদের জন্য লিখতে গেলে বা তাদের জন্য লেখা সম্পাদনা করতে গেলে ওদের মতো করেই ভাবতে হবে। আরেকটি কথা মনে পড়ছে। প্রকাশনার প্রথম থেকেই ‘সাতরং’ পত্রিকাটি দেশের প্রতিটি ব্র্যাক স্কুলে যেত। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিয়মানুযায়ী সময় ভাগ করে নিয়ে একজনের পর আরেকজন ‘সাতরং’ পাঠ করত। আমি সে সময়ের কথা বলছি যখন ‘সাতরং’ সবে বেরুচ্ছে। একবার আমি খেলাধুলার পাতার জন্য একটি ছবি নির্বাচন করলাম। সেখানে পাঠকদের ছবিটি রং করতে বলা হয়েছে। দাদা বললেন, ‘ছবিটির লাইন ধরে ডট-ডট দিয়ে দেন এবং তা আঁকতে বলুন। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই বইটির পাঠক। তারা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের কাছে রংপেন্সিল নাও থাকতে পারে। তখন তারা মনে কষ্ট পাবে।’ আমি সেদিন থমকে গিয়েছিলাম। এখন অবশ্য ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকেই রংপেন্সিল দেওয়া হয়।
‘সাতরং’ পত্রিকায় শহুরে চাকচিক্যময় জীবন নিয়ে কোনো লেখা লিখতে গেলেও দাদা বলতেন, ‘এসব তো গ্রামের দরিদ্র শিশুদের কাছে সহজলভ্য নয়। সুতরাং তাদের মতো করে ভাবুন।’ এ তো গেল ‘সাতরং’-এর বিষয় নির্বাচনের কথা। তাঁর সম্পাদনা নিয়েও একটু বলতে চাই। দাদা ছিলেন ‘সাতরং’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। সেজন্য ‘সাতরং’-এর প্রতিটি রচনাই আমার সাধ্য মতো ঠিকঠাক করে তাঁকে দিতাম। আমার চোখে ভ্রান্তিহীন সেরা সে রচনাগুলো তার কাছে নিয়ে গেলে তিনি সম্পূর্ণ রঙিন করে সেগুলো আবার কারেকশন করতে বলতেন। অর্থাৎ লালকালি দিয়ে এর বাক্যের গঠন এবং অসংখ্য খুঁটিনাটি বিষয় মুহূর্তের মধ্যে ঠিক করে দিতেন। আমি আবারও পড়তাম এবং ভাবতাম, কীভাবে তিনি পারেন? লেখকের মনের কথাগুলো যেন ছবির মতো আমার চোখে ভেসে উঠত। তিনি একটি লেখা বারবার পড়তেন এবং ঠিক করতেন। শব্দগুলো যেন তার খেলার সঙ্গী। নানাভাবে সাজাতেন, ভাঙতেন, আবারও সাজাতেন।
সুবলদা শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-ছড়ায় ছড়ায় শুদ্ধ বানান, ছড়ায় ছড়ায় শুদ্ধ ভাষা, জাদুর তুলি, ঈশপের কাহিনীসমগ্র, ক্ষুদে বিজ্ঞানী সিরিজ, সাতটি কাক ও একটি বোন, ভিনদেশি গল্প, সাদামেঘ কালোমেঘ, চাঁদের জামা, নিঝুমবনের সাদাহাতি, টিনের সেপাই, পাখি সব করে রব। সম্পাদনা করেছেন অনেক ভালো ভালো বই। লেখকের লেখা নির্ভুল ও পাঠোপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ও ধৈর্যে কখনও ছেদ পড়তে দেখিনি। তিনি একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, আমি যখন কোনো লেখা পড়ি তখন আমার চোখ ভুল দেখলে আটকে যায়। লেখার মধ্যে কোথাও ভুল আছে কি না তা আমি খুঁজে দেখবই। এটা আমার অভ্যাস। বলতে পারো লেখার ভুল খুঁজে বের করাতেই আমার আগ্রহ, আনন্দ।
বাংলাভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বানান সব বিষয়েই তার জুড়ি মেলা ভার। সেইসঙ্গে স্মরণশক্তির কথাও বলতে হয়। দাদার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা হয়তো সবাই জানেন, তিনি কম্পিউটার ব্যবহারে সাবলীল ছিলেন না। সুতরাং তিনি প্রিন্টকপি সংশোধন করতেন। ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে সংশোধন আসতেই থাকত। একবার, দুইবার, তিনবার…অসংখ্যবার। তাঁর অনেক লেখার সফটকপি থাকত আমার কাছে। আমার কম্পিউটারের ফাইনাল কপি কখনও কখনও ডিজাইনে যাওয়ার পরও তিনি পরিবর্তন করতেন। অনেক সময় তিনি লেখার ফাইনাল কপি আবারও দেখতে চাইতেন। সেই ফাইনাল কপি দেখে অনায়াসে বলে দিতে পারতেন সেটিই লেখাটির সর্বশেষ পরিমার্জিত রূপ কি না। কখনও কখনও দেখেই বলতেন এটি সর্বশেষ কপি নয়। চূড়ান্তটির এই জায়গায় কারেকশন ছিল। আমি প্রতিবাদ করতাম না। কারণ, আমি জানি তিনি জেনেবুঝেই বলেছেন।
সুবলদা কথা বলতেন কম। খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন ভীষণ পরিশ্রমী। সারাক্ষণ নীরবে নিজের কাজ করতেন। কর্মক্ষেত্রে কাছাকাছি বসার কারণে অনেক সময় তাঁর কাছ থেকে মজার মজার ঘটনা, অভিজ্ঞতা ও গল্প শুনতাম। সেগুলো আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়ে যাবে চিরদিন। মাঝেমাঝে তিনি কথার ভুলও ধরিয়ে দিতেন। মনে পড়ে, কেউ যদি বলত, খাবারটা খুব মজা হয়েছে। তিনি বলতেন, ‘খাবার কি মজা হয়? খাবার হয় স্বাদের।’ আবার কাউকে হয়তো বললাম, ‘ফোন দিও।’ দাদা বলতেন, ‘তোমার ফোন তাকে দেবে, না তার ফোন তোমাকে দেবে?’ তারপর অমায়িক হাসি দিয়ে বলতেন, ‘কথাটি হবে, ফোন কোরো।’ আমি এখনও অভ্যাসবশত এ ধরনের কথা বলতে গিয়ে দাদার কথা ভেবে একটু থমকে যাই। এরপর শুদ্ধ করে বলি। এভাবেই আমার প্রতিদিনের পথচলায়, কাজে, প্রেরণায় তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন এবং থাকবেন।