‘এত্তডি মানুষ! মরছে, এহনতো লাশটা খুইজ্জা পাই না। রক্তে ডুবানি। পরে পারা দেই, একটু আগায় যাই, রক্তে ওখানে ঝুল পারে। চাপ বাইন্দা গেছে। এরপর একটা ছুডু ঘটি দিয়া মাইট্টা কুয়াত্তে পানি তুলছি। তুইল্লা মুখ ধুইছি সবডির। ধুইয়া ৩/৪ জন দেহার পরে আমার স্বামীরে পাইছি। বুকের ভেতরে যে গুলি গেছে হেইডা দেখা যায়।’
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রাম সোহাগপুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত থেকে এই পথেই অনেক মুক্তিযোদ্ধা দেশে প্রবেশ করে অপারেশন চালাতেন। সোহাগপুরের অনেকেই তখন গোপনে তাঁদের জন্য খাবার আর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন।
আক্রোশ থেকেই পাকস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা এই গ্রামে হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই এই গ্রামের ১৮৭ জন নিরস্ত্র মানুষ শহীদ হন। নির্যাতনের শিকার হন অনেক নারী। সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ মারা যায়। সে কারণেই স্বাধীনতার পরে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘সোহাগপুর বিধবাপল্লি।
মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে সোহাগপুর গ্রামে যারা স্বামীহারা হয়েছিলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি প্রতিমাসে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে দেয়, যা এখনও চলমান। এ ছাড়া অনেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা হয়।
ভাতা প্রদান কর্মসূচি কীভাবে চালু হলো সেই গল্পও বললেন রিয়াজ ভাই। ১৯৯৬ সালে আবেদ ভাই একদিন তাকে সোহাগপুরের বিধবাপল্লির নারীদের জন্য সম্মানজনক কিছু করার কথা ভাবতে বললেন। তিনি চেয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় স্বজন হারানো অসহায় নারীরা যেন মর্যাদাপূর্ণ জীবন পায়।
রিয়াজ ভাইয়ের কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জেনে আমরা সোহাগপুরে যাই। সেখানে কথা বলি কয়েকজন বৃদ্ধার সঙ্গে, যারা একাত্তর সালের জুলাই মাসে বিধবা হয়েছিলেন। এই নারীদের জীবনযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সেইসব নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজনের ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। তাঁদের বর্ণনায় সেদিনের বীভৎস স্মৃতি উঠে এসেছে।
ফরিদা বেওয়া
ফরিদা বেওয়ার বয়স ১শ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু মনে আছে সেদিনের কথা। সকালে বাঁশ দিয়ে ধামা বোনার কাজ করছিলেন তার স্বামী। হঠাৎ খবর পেলেন গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে। ঘরদোর সব ফেলে জান বাঁচাতে আশ্রয় নেন গারো পাহাড়ের এক বাড়িতে। সেখানে গিয়েও রক্ষা পাননি। ফরিদার সামনেই তার স্বামীসহ মোট ৪ জনকে তারা গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
ফরিদা বেওয়া
মিলিটারি চলে যাওয়ার পর ফরিদার চাচা শ্বশুর গ্রামবাসীদের সহায়তায় মশারি দিয়ে কোনোরকমে পেঁচিয়ে ৪ জনকে একসঙ্গে কবর দিয়েছিলেন। সংরক্ষণের অভাবে সে কবরও নিশ্চিহ্ন।
মোছাঃ হাফিজা বেওয়া
একাত্তর সালে ১৫-১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় হাফিজা বেওয়ার। স্বামীকে নিয়ে ‘নাইওর’ এসেছিলেন সোহাগপুরের উত্তরপাড়ায় বাবার বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই বাড়ির উঠোনে একসঙ্গে ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যার মধ্যে ৭ জনই ছিলেন হাফিজার পরিবারের সদস্য। মৃত স্বামী ও বাবাসহ ৯ জনকেই একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়।
মোছাঃ হাফিজা বেওয়া
সেই ঘটনা বলতে গিয়ে হাফিজা বলেন, ‘বাবা-চাচারে ঘর থেইকা টাইন্যা নিয়া মারছে। ছনের বেড়া আছিল, আমার স্বামী বেড়া ভাইঙ্গা দৌড় মারছে। অমনি গুলি কইরা চাপাডার ওই সাইডে লাগছে। দাঁতদুত শুদ্দা ভাইঙ্গা এইহানদ্যা এক্কার গলাডা ছিইল্লা একসাইড হইয়া গেছে। আরেকটা মারছে এইহানদ্যা, পেট দিয়্যা গুলি বাইর হই গেছে।’
ঝর্ণা দিও
সেদিনের কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠেন ঝর্ণা দিও। পাকিস্তানি সেনা আসছে শুনে স্বামী রমেশ রিছিল বলেন, সে যেন বাড়ির কাছের খেতে গিয়ে ধানের রুয়া লাগাতে থাকে। ধারণা ছিল সাধারণ গ্রামবাসী ভেবে হয়তো ছাড় দেবে। আরও বলেছিলেন, যদি সেনারা গুলি চালায় তাহলে যেন উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং নড়াচড়া না করে। সে কথা মেনেই ঝর্ণা দিও বেঁচে গেছেন।
ঝর্ণা দিও খেতে চলে যান। একটু পরে রমেশ রিছিলসহ আরও অনেক পুরুষকে ধরে এনে ওই ধানখেতে জড়ো করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা নির্বিচারে গুলি চালায়।
ঝর্ণা দিও
‘বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হলে আমি মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি। বিহারিগুলো (পাকিস্তানি সেনা) আমারে কইতাছে, এই বেটি মরে নাই, মার মার। এই বেটি মরে নাই এখনও। আমারে এক্কেরে পাড়া দিল বুট জুতা দিয়া। মরো মরো, মরতে জাগা পাওনা? আমি চুপ করে থাকলাম, ঈশ্বর যেন আমারে বাঁচায় রাখে, আমি যেন এই জমি থেইক্কা উইট্টা দৌড় দিতে পারি। চুপ কইরা থাকলেও আবার আইয়া আমারে পাড়া দিল। তখন ওদের বড় সাহেব কইল, থাক সব মরে গেছে, এখন আর গুলির অর্ডার নাই। ঈশ্বরের কৃপায় আমি এখনও বেঁচে আছি।’
গুলি খাওয়ার তিনমাস পর আহত অবস্থায় তার স্বামী মারা গিয়েছিলেন। বর্তমানে ঝর্ণা দিও প্রচণ্ড অসুস্থতায় একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
মালতী রাকসাম
সকাল হয়েছে। বাড়ির পাশে জমিতে ধান রোয়ার কাজ করছিলেন মালতী রাকসাম, তার স্বামী এবং ভাই। তাদের মতো আরও অনেকে আশেপাশের খেতে কাজ করছিলেন। মালতী তখন গর্ভবতী। হঠাৎ করেই যেন বিপদে এলো! পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা কয়েকজনকে ধাওয়া করতে করতে তাদের জমিতে চলে আসে। তারপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। জমিতে কাজ করতে থাকা নিরীহ মানুষেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারায়। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়ে কাদার মধ্যে পড়ে যান মালতী এবং প্রাণে বেঁচে যান। পরে যখন জ্ঞান ফেরে তখন উঠে দেখেন, তার স্বামী, ভাই এবং আরও কয়েকজনের মৃতদেহ সেখানে পড়ে আছে।
মালতী রাকসাম
এখনও সোনালি ধানে ভরে ওঠে বাড়ির পাশের ফসলের মাঠ। কিন্তু সেদিকে তাকালে মালতী রাকসামের সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতিই মনে পড়ে।
জুবেদা বেওয়া
সেদিন নাশতা খেয়ে হাল নিয়ে বের হয়ে যান জুবেদা বেওয়ার স্বামী। তার হুঁকো টানার অভ্যাস ছিল। যাওয়ার সময় বড় মেয়ের কাছ থেকে হুঁকো চেয়ে নেন এবং তাকে ভাত বসাতে বলেন। কেউই আঁচ করতে পারেনি আজ কী ভীষণ কাণ্ড ঘটতে চলেছে।
স্বামী কাজে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাড়িতে বসেই গুলির শব্দ শুনতে পান জুবেদা। একটু পরে তার স্বামীও হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসেন। জুবেদাকে জানান, গ্রামে হামলা শুরু হয়েছে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে সে যেন ঘরের ভেতরেই থাকে। জুবেদা তাকেও ঘরে থাকতে বলেন, কিন্তু বাইরে কী ঘটছে তা দেখার জন্য তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পরিবেশ যখন শান্ত হয়, তখন গ্রামের এক ভাতিজার কাছ থেকে জুবেদা জানতে পারেন, গ্রামের একটি বাড়িতে তার স্বামীসহ আরও অনেক পুরুষ একসঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন, সেখানেই তাদেরকে মারা হয়।
জুবেদা বেওয়া
জুবেদা বলেন, ‘দেলা নামে আছিন, দেলার বাড়ি যাইয়া দেহি উঠানডা ভইরা গেছেগা। মাইরা ফালাই থুইছে। আমার স্বামীর মাথাডা আছিন দক্ষিণবা, ঠ্যাংডা আছিন উত্তরবা। আইয়া দেখলাম সারা গায়ে রক্ত, হুঁশ নাই, বেহুঁশ। করলাম কী, ছ্যাচাড়াইয়া উত্তর শিয়রি করলাম। উওর শিয়রি কইরা দৌড় প্যারে বাড়িত গেছি। বাড়িত যাইয়া একটা চাদর আনছি। অহন কার মরা কারা গাড়ে। খবর পাইয়া সবাই আইছে। কিয়ের মাডি, চাপা মাডি। এক গর্তের মইধ্যে ৩/৪ জন কইরা ফালাইছে। পরে আমার পিন্দনে সাদা কাপড় আছিন; পিন্দনের সাদা কাপড় দিয়া; একটু পানি ছিডাই দিয়া; একটু বাংলা সাবান দিয়া; পানি ছিডাই দিয়া ৩ জনরে মাডি দিছি।’
জুবেদা বেওয়ার বড় মেয়ে রাবিয়া খাতুনও পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার সাক্ষী। ওইদিন রাতে মেয়ের সামনেই জুবেদা বেওয়া আর তার কোলের ছেলেকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার দেখে কোলের শিশুটি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর কয়েকদিন পরেই তিনি তার ছেলেকে হারান।
মহিরন বেওয়া
‘এত্তডি মানুষ! মরছে, এহনতো লাশটা খুইজ্জা পাই না। রক্তে ডুবানি। পরে পারা দেই, একটু আগায় যাই, রক্তে ওখানে ঝুল পারে। চাপ বাইন্দা গেছে। এরপর একটা ছুডু ঘটি দিয়া মাইট্টা কুয়াত্তে পানি তুলছি। তুইল্লা মুখ ধুইছি সবডির। ধুইয়া ৩/৪ জন দেহার পরে আমার স্বামীরে পাইছি। বুকের ভেতরে যে গুলি গেছে হেইডা দেখা যায়।’ মহিরন বেওয়া বলে চলেন।
মহিরন বেওয়ার স্বামী মাঠে ধান রোয়ার কাজ করছিলেন। গ্রামে ঢুকে পাকিস্তানি বাহিনী যখন গুলি চালানো শুরু করে তখন দৌড়ে কাছাকাছি একটি ঘরে গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। ওই ঘরে তারা মোট ৯ জন ছিলেন। গুলি করে ৯ জনকেই নির্মমভাবে হত্যা করে। মহিরন আর তার শাশুড়ি একইদিনে বিধবা হন।
মহিরন বেওয়া
মাঠে যখন গুলি চলছিল মহিরন তখন বাড়িতে। শ্বশুর আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ওরা নিরীহ মানুষকে মারবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ওদের শত্রুতা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানি সেনারা এসে হাজির হয়।
স্থানীয় ৪ জনের সহায়তায় স্বামী ও শ্বশুরকে কবরস্থ করেন মহিরন। গর্ত খুঁড়ে সবাইকে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়। স্বামীর মৃতদেহ দেখার সময় রাজাকারদের চোখে পড়ে যান মহিরন। অনেক মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল। কোনোভাবে সেদিন রেহাই পান। যুদ্ধ চলাকালে অন্য সময়ে অনেকবার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। গ্রামের অনেক নারীর অবস্থাও তার মতোই ছিল।
আমেনা বেওয়া
আমেনার বয়স তখন ১২/১৩ বছর। আমেনা বলেন, ‘বন্দ শুদ্দা তো মারতাছে, মাইরা হাইরা দুজন গিয়া বাড়িত ঢুকছে। আমার দাদা হউর এইরাম বারান্দাত বইয়া হাইরা হুঁকো খাইতাছে। একটা আপনার গিয়া আমার দাদা হউররে লইয়া গেলগা ঘরের গজ, গিয়া হোয়ানে মাইরা থুইলো। মারলে পরে আরেকটা যায়া ঘরে উঠল, ঘরে উইঠা পরে নির্যাতন করল।’
আমেনা বেওয়া
গ্রামে পাকিস্তানি সেনা ঢুকেছে শুনে আমেনার স্বামী বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় মা-বাবাকে আমেনার খেয়াল রাখার কথা বলে যান। ভেবেছিলেন, বাড়িতেই তারা নিরাপদে থাকবে। আমেনার স্বামী পালিয়ে গেলেন বাড়ির পশ্চিম কোণার একটি ফসলের খেতে। সেখানে আরও ৬ জন ধান রোয়ার জন্য চারাগুলোকে আলাদা করার কাজ করছিলেন। তাদের সবারই ধারণা ছিল কাজ করতে থাকলে পাকিস্তানি সেনা হয়তো কোনো ক্ষতি করবে না। বাস্তবে ৭ জনকে জমিতেই গুলি করে হত্যা করে। গ্রামের মানুষ কোনোভাবে গর্ত খুঁড়ে ৭ জনকে একসঙ্গে কবর দেয়। এখন সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে।
যাদের ঘটনা বললাম তাদের সঙ্গে কথা হলো। কিন্তু এর বাইরে অনেকেই আড়ালে রয়ে গেল। এক সকালে সোহাগপুরের মানুষ দেখেছিল যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ! চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মম বর্বরতার ইতিহাস সোহাগপুরবাসী কোনোদিন ভুলতে পারবে না। সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ছবি: জি.এম. ফাহমিদ আহসান উল্লাহ
কারিগরি সহযোগিতা: ফুয়াদ রাব্বী শুভ্র