নারীদের চোখেমুখে শঙ্কার ছাপ স্পষ্ট। যাপিত জীবনে তো তাদেরকে কম অবহেলা আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি! অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা কবিতা দিদির কাছে এসেছেন। যে বয়সে জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু করে হাসি-আনন্দে মুখরিত দিন পার করার কথা ছিল তাদের, সে বয়সে হঠাৎই যেন থমকে গেছে সবকিছু।
শহরবানুর (ছদ্মনাম) হাতে তালাকনামা দেখে আমি কৌতূহলী হয়ে তার কাছে সবিস্তারে জানতে চাইলাম।
শহরবানু নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করলেন, “আমার স্বামী এই তালাকের কাগজটা পাঠাইছে। আমার সাথে আর ঘর কইরবার চায় না।”
তার চোখ পানিতে টলটল করছে। অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখে তিনি বলে চললেন-
“আইজ থেইকা পনেরো বছর আগে আমাদের বিয়া হয়। আমি বিভিন্ন জায়গায় চুক্তিতে মাটি কাটার কাজ করতাম। তিনি আইসা বইসা থাকতেন। আমার সবকিছুর ব্যাপারেই খোঁজখবর নিতেন। আমারে বিয়া করার জন্য পাগল হয়্যা গেলেন। দুই ছাওয়াল ছোটো রাইখা আমার আগের স্বামী মইরা গেছে। স্বামীর পক্ষেও ছাওয়াল-মাইয়্যা আছে। আমি রাজি হইলাম। দুইজন সাক্ষী নিয়া কাজির অফিসে বিয়া পড়ান হইলো। এরপর থেইকা তিনি আমার বাড়িতেই থাকতেন। আগেই কথা আছিল কোন বাচ্চাকাচ্চা নেব না। তিনিও আমার কথায় সায় দিছিলেন। আর এহন বলতেছে, তুই আমারে কি দিছস?”
রবিবার সকাল। ঘড়ির কাঁটায় দশটা বেজে গেলেও সূর্যের দেখা নেই। চারপাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে কাছের জিনিসও চোখে পড়ে না। বাংলাদেশের অন্য জায়গাগুলোর মতো খুলনাতেও পৌষের শীত জেঁকে বসেছে। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল খুব একটা নেই। এমন কনকনে ঠান্ডায়ও পরিবর্তন হয়নি কবিতা মন্ডলের রুটিন। সাড়ে আটটার মধ্যেই অফিসে পৌঁছে খাতাপত্র গুছিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ব্র্যাককর্মী হিসেবে আমিও সে অফিসে কাজ করছিলাম। কবিতা দিদি অফিসে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে ঘিরে নানা বয়সি নারীদের ভিড় জমে যায়।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে জটলা বাড়তে থাকে। তারা কবিতা দিদির কাছে এসেছেন ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায়। অনেকেই সাথে এনেছেন তাদের বাচ্চাদের। যারা একটু বয়সে বড়ো, হাঁটা-চলাফেরা করতে পারে, তারা সমবয়সি অন্যদের পেয়ে বারান্দায় হৈ-হুল্লোড় আর খেলাধুলোয় ব্যস্ত। আর একেবারেই ছোটোরা সোয়েটার, কানটুপি আর মোজা পরে মায়ের কোলে চুপ করে বসে আছে। অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু।
শহরবানু তার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কবিতা দিদিকে বললেন, “আমার যত টাকা-পয়সা আছিল সব নিয়া গেছে সে। মাঝেমধ্যে মারধরও করত। আমার সাথে নাকি আর সংসার করবে না! তাই তালাকের কাগজ পাঠাইছে।”
“আপনি কী চান?”
“আমার চাওনের কী আছে! এই বয়সে মানুষরে মুখ দেখাইবার পারতেছি না। ছেলেপিলে, ছেলের বউ আমারে কানতে না করছে। এহন সে যদি সংসার নাই করে, আপনেরা আমার দোনমোহরের পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়া দ্যান। “
“কাবিননামা সাথে এনেছেন?”
উত্তরে তিনি মাথা নেড়ে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। কাগজটা উল্টে দেখে কবিতা দিদি জানান,
“দেনমোহর হিসেবে পাঁচ হাজার টাকার কথা লেখা আছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা কে বলেছে আপনাকে?”
“বিয়া পড়ানোর সময় তো এই কথাই আছিল। যে বিয়া পড়াইছে তিনিও তাই বলছিলেন।”
কবিতা দিদি তার কথা শুনে জবাব দিলেন, “মিথ্যা কথা। আপনাকে পঞ্চাশ হাজার বললেও এখানে পাঁচ হাজার লিখা।“
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শহরবানু। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা কতভাবে ঠকে! শত নিপীড়ন সহ্য করেও তারা স্বামীর ঘর করতে চায়। এরপরও তালাক হয়ে গেলে মুখ বুজে কাঁদে। জীবনের শেষবেলায় এসে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তারা কী তা স্বপ্নেও ভেবেছিলেন!
আমি দেখলাম অফিসে অভিযোগ দায়ের করতে আসা নারীদের চোখেমুখে শঙ্কার ছাপ স্পষ্ট। যাপিত জীবনে তো তাদেরকে কম অবহেলা আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি! অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা কবিতা দিদির কাছে এসেছেন। কবিতা মন্ডল ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত। সকাল থেকেই তিনি সবার ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনে সেগুলো নথিভুক্ত করছেন। যারা বসে আছে অধিকাংশের বয়সই ছাব্বিশ-সাতাশের ঘরে।
ভাবছি, যে বয়সে জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু করে হাসি-আনন্দে মুখরিত দিন পার করার কথা ছিল তাদের, সে বয়সে হঠাৎই যেন থমকে গেল সবকিছু। বাল্যবিয়ের করুণ পরিণতি এখন তাদের বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন।
আমাদের সমাজে বিয়ের সময় বা তার পরে যৌতুক দিয়ে যে টাকা মেয়ের সুখের জন্য পরের ছেলের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, সেই টাকার কিছু পরিমাণও যদি মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে খরচ করত, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তার বিয়ে না দিত, তবে আজ মেয়েকে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া লাগত না।
সব হারিয়ে সামান্য একটু আশা নিয়ে তখন নারীরা অভিযোগ নিয়ে ব্র্যাক লিগ্যাল এইড ক্লিনিকে আসেন। সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা (SELP) কর্মসূচির বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (ADR) তাদেরকে শুধু পারিবারিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতেই সহায়তা করছে না, সেইসাথে দেনমোহর ও ভরণপোষণ বাবদ টাকা পেতেও সহায়তা দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ADR ও কোর্টের মাধ্যমে SELP ভুক্তভোগীদের পক্ষে ৪৫০ কোটি টাকা আদায়ে সক্ষম হয়েছে।
এ কেবল নিছক কোনো সংখ্যা নয়, একে বিবেচনা করতে হবে পরবর্তী সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অস্ত্র হিসেবে। তাছাড়া, অভিযোগ আসছে মানে নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষ আওয়াজ তুলছে। যা নারী নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পূর্বাভাসও বটে।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন