কোনো উপায় নেই বলেই হয়তো বাড়ির স্কুলে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটিকে কাজে যুক্ত হতে হয়েছে। দেখা যায়, এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, পথশিশু, শরণার্থী, দুর্যোগ কবলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অনেক কিশোরী মেয়ে এখন ঘরের কাজে বেশি সময় দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা হয়তো বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার কথা এখনই ভাবছে না।
দেড় বছর বন্ধ থাকার পর স্কুল খোলার দিনটি শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর সাথে মিশে আছে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া আর একসাথে লেখাপড়া, খেলাধুলোর আনন্দ। দীর্ঘ ছুটি শেষে স্কুলে যাবার যে চমৎকার দৃশ্যটি মনে উঁকি দেয় সেখানে খানিক কালো মেঘের আনাগোনা কি চোখে পড়ছে না?
শিক্ষার্থীরা সবাই কি এই আনন্দে শামিল হতে পারল? না, কেউ কেউ স্কুলে ফিরে যাওয়ার আশা ত্যাগ করেছে। কারণ, মাহামারিকালে টিকে থাকার লড়াই তাদের অন্য এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়া কোনো কোনো শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলে ফেরা আজ অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারিতে জীবিকা হারিয়ে কোনো কোনো পরিবার ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে, কেউ কেউ এই মহামারিতে হারিয়েছে তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। এরফলে শুরু হয় দিশেহারা এসব পরিবারের টিকে থাকার লড়াই।
কোনো উপায় নেই বলেই হয়তো বাড়ির স্কুলে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটিকে কাজে যুক্ত হতে হয়েছে। দেখা যায়, এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, পথশিশু, শরণার্থী, দুর্যোগ কবলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অনেক কিশোরী মেয়ে এখন ঘরের কাজে বেশি সময় দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা হয়তো বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার কথা এখনই ভাবছে না।
অনেকদিন ধরে কোনো দুর্যোগ বা অনিশ্চয়তা চলতে থাকলে দরিদ্র পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন বাড়তে থাকে। তখন অনেক দরিদ্র মা-বাবা তাদের কন্যা সন্তানের বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ, এতে সংসারের খরচ কমবে। এছাড়াও নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুক কম দেওয়া এরকম বিষয়গুলোও বাল্যবিবাহের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে।
তাই মহামারিতে বাড়ছে বাল্যবিবাহ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এই হার ভীষণই শঙ্কাজনক। ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল।
ছবি: ব্র্যাক/নাজমুল সানজি
চুয়াডাঙ্গার মেয়ে বর্ষা সম্প্রতি নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হবে এই স্বপ্ন তাকে সাহসী করে তুলেছে। দুঃসময় বিবেচনা করে পরিবার যখন বিয়ে ঠিক করে তখন প্রথমবারের মতো সে থানায় যায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার সমস্যার কথা জানায়। শেষপর্যন্ত তাদের হস্তক্ষেপেই বিয়ে বন্ধ হয়।
ভালো কিছুর জন্য কারও কারও কোনো সাহসী পদক্ষেপ অন্যদের মনে দারুণভাবে রেখাপাত করে। ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা আবার যেদিন স্কুলে ফিরে গিয়েছে সেদিন তাকে স্বাগত জানাতে সহপাঠীদের করতালিতে মুখর হয়ে উঠেছিল ক্লাসরুম।
যারা স্কুলে ফিরে এসেছে তাদের ধরে রাখাটাও কি চ্যালেঞ্জ নয়? এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে ভয়-শঙ্কা দূর করে স্কুলে আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে আগ্রহ হারাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ। বাড়বে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সংখ্যা। সুতরাং শিক্ষার্থীর স্কুলে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার মতো সমস্যা সমাধানে নজর দেওয়া যেমন দরকার তেমনি সচেতন করে তোলার বিষয়টিরও সমান মনোযোগের দাবি রাখে।
বিপর্যয় মোকাবিলা করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা মানুষের স্বভাবজাত। এই যে কোভিডের কারণে নিত্যকার সাধারণ জীবনে হঠাৎ ছন্দপতন, তাতে কি আমরা থেমে পড়েছি? না, আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। টিকা নেওয়া, সুরক্ষার নিয়মগুলোÑ মুখে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছি। স্কুলে এ নিয়মগুলো মেনে চলতে হয় সব শিক্ষার্থীদের। বিশ্ব শিখেছে, নিয়ম মেনে কোভিড মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সুবাতাস বইছে, আমাদের দেশে কোভিড সংক্রমণের হার এখন নিম্নমুখী।
সম্পাদনা-সুহৃদ স্বাগত
কভার ছবি-আব্দুল্লাহ্ আল কাফি