আমিন ছিল অত্যন্ত কর্মঠ আর অঙ্গীকার পালনে গভীরভাবে দায়বদ্ধ। একটি কাজ নিয়ে সেটি ফলপ্রসূ না করে তোলা পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হতো না। মোট কথা, সে ছিল দায়িত্ববান। এক্ষেত্রে তার একটুও শৈথিল্য ছিল না।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্য আমাদের ওপর যে বড়ো একটি দায়িত্ব অর্পণ করেছিল, সেটি হলো স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করা এবং দারিদ্র্য দূর করে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য কাজ করা। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে শোষণমুক্ত ও ন্যায়বিচারসম্পন্ন একটি সমাজ গড়বার প্রত্যয়ে আমরা ব্র্যাক গড়ে তুলেছিলাম। সদ্য স্বাধীন দেশে বহু তরুণ সেদিন দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ব্র্যাকে এসে যোগ দিয়েছিল। একটি ছোটো পরিসরে আমাদের কাজটা শুরু হয়েছিল, পরে ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে আমিনুল আলম আমার কাছে আসে। তার ইচ্ছে সে ব্র্যাকে কাজ করবে। আমিনের সঙ্গে আমি কথা বলি। আমিনকে দেখে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, সে অত্যন্ত পরিশ্রমী, কাজ করবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বেশ আগ্রহ নিয়েই আমিনকে আমি ব্র্যাকে নিয়োগ দিই।
১৯৭৫ সালের প্রথমদিকে তদানীন্তন রংপুর জেলার রৌমারীতে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল, লোকজন খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছিল। শিশুরা মারা যাচ্ছিল বেশি, বাড়ির পুরুষরা স্ত্রী-সন্তান রেখে কাজের খোঁজে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমরা রৌমারীতে একটা প্রকল্প হাতে নিই। আমিন ব্র্যাকে এসে এই প্রকল্পে কাজ শুরু করে। আমিন ওখানে খুব দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিল। রৌমারীর পর আমিনকে আমি মানিকগঞ্জের নতুন প্রকল্পে কাজ শুরু করতে বলি।
আমিন ছিল অত্যন্ত কর্মঠ আর অঙ্গীকার পালনে গভীরভাবে দায়বদ্ধ। একটি কাজ নিয়ে সেটি ফলপ্রসূ না করে তোলা পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হতো না। মোট কথা, সে ছিল দায়িত্ববান। এক্ষেত্রে তার একটুও শৈথিল্য ছিল না। মানিকগঞ্জ প্রকল্পে আমি তাকে একজন পিও হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম। প্রকল্পে একজন ম্যানেজার ছিল, পরে দেখা গেল তাকে ছাড়াই আমিন নিজে প্রকল্পের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে। আমি তখন তাকে প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিই এবং আমিন তার নতুন দায়িত্বে কাজ শুরু করে।
আমিনের মধ্যে অনেকগুলো গুণ ছিল। যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা কাজ করি, তাদের প্রতি তার ছিল গভীর empathy বা সহানুভূতি। মূলত এই empathy-র তাড়নাতেই আমিন আমাদের কর্মসূচির লক্ষিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করে যেত। কর্মীদের সুখদুঃখ, ভালোমন্দের ব্যাপারে সে ছিল খুবই সজাগ। শুরুতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের সঙ্গেও আমরা কাজ করতাম। কর্মীরা রাতের বেলায় সংগঠনের পুরুষসদস্যদের সঙ্গে মিটিং করত। দিনের বেলায় পুরুষদের পাওয়া যেত না বলেই মিটিং হতো রাতে। মিটিং সেরে কর্মীদের ফিরে আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যেত। কিন্তু শেষ কর্মীটি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমিন খাবার খেত না। রাত দশটা-এগারোটা যা-ই হোক না কেন, আমিন তাদের জন্য অপেক্ষা করত।
মোঃ আমিনুল আলম (১৯৪৯-২০১০)
দরিদ্র জনগণের প্রতি আমিনের সহানুভূতি-সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত গভীর। এটা আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। যেটা আমার মধ্যে কিছুটা আছে এবং এটা আমি আমিনের মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় দেখেছি। আমি যখন প্রোজেক্টে যাই তখন দেখি যে, অনেক গরিব লোক ঋণ নেওয়ার জন্য আমাদের অফিসের বাইরে বসে আছে। আমি একদিন বললাম, ‘আমিন, এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকজন চার-পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার জন্য বসে থাকে, এতে তো ওদের সময় নষ্ট হয়। ওরা তো ব্যস্ত মানুষ।’ আমিন তখন বলল, ‘আবেদভাই, আমিও সেটা ভাবছিলাম যে কী করব। আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে ওদেরকে ‘কাল এসো’ বলব না। নির্দিষ্ট সময়ে আসতে বলব। বলব, দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে এই ছয়জনকে, এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে এই ছয়জনকে লোন দেওয়া হবে। এতে আর ওদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না।’
এভাবেই ব্র্যাকের কর্মধারায় আমিন কিছু নিয়ম প্রবর্তন করেছিল। ব্র্যাকের কর্মীদের সে বোঝাতে পেরেছিল, গরিবদের সময়ের মূল্য কোনো অংশেই কম নয়। ব্র্যাকের অফিসে সরকারি অফিসের মতো লোক বাইরে বসে থাকে এটা ঠিক নয়। গ্রামসংগঠনের যে সদস্যরা আমাদের কাছে আসে, তারা তো আমাদেরও ভোক্তা। তাদেরকে স্বাগত জানাতে হবে, দ্রুত ও কার্যকরভাবে তাদের সেবা দিতে হবে। এই ব্যাপারগুলো আমিন খুব ভালো বুঝত। গরিব মানুষের সেবা পাওয়ার ব্যাপারে কোনো শৈথিল্য সে সহ্য করতে পারত না।
আমি আর আমিন-আমরা দু’জনই এসেছি বামপন্থি রাজনীতি থেকে। বামপন্থি রাজনীতির মূল কথা হলো সাম্যবাদ। অর্থাৎ সব মানুষই সমান। সবার সমান সুযোগ থাকা চাই-এই জিনিসটা বামপন্থি রাজনীতি থেকে আমরা পেয়েছি। এই পন্থার মূল কথা কেউ কারও থেকে ছোটো নয়। এই বিশ্বাস আমার মধ্যে আছে এবং আমিনের মধ্যে এটা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। আরও একটি বিষয়ে আমিনের প্রবল আস্থা ছিল। আর সেটি হচ্ছে জেন্ডারসাম্য। এই বিশ্বাস তার এতটাই দৃঢ় ছিল যে, নারীপুরুষে কোনো পার্থক্য করা তার চিন্তার মধ্যেই আসত না। আসলে নারীরা সংসারের দায়িত্ব নেয়। শিশু লালনপালনের দায়িত্ব, পরিবারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব-আরও অনেক রকমের দায়িত্ব পুরুষেরা নেয় না। আমার মতো আমিন এ বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবত।
আসলে আমিন আর আমার মধ্যে অনেক বিষয়েই ভাবনার মিল ছিল। আমি ব্র্যাকের যত কর্মীর সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের মধ্যে আমিনের সঙ্গেই আমার সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে। আমরা অনেক সময় একত্রে ফিল্ডে গিয়েছি, রংপুর বা যশোরে যাওয়ার সময় গাড়িতে আট ঘণ্টা ধরে আলাপ করেছি। অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে। আমি সব সময় তাকে একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে দেখতে পেয়েছি।
আয়েশা আবেদের সঙ্গে আমিনুল আলম
ব্র্যাকের বিস্তার ও কর্মধারার প্রসার ঘটাতে আমি আর আমিন দু’জনেই সংকল্পবব্ধ ছিলাম। আমরা সর্বদাই ব্র্যাকের কর্মসূচি সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছি। আমিন না হলে আমাদের এই প্রসার হয়তো এতটা হতো না। অন্যরা অত দক্ষ ছিল না, অন্যদেরকে দক্ষ করে তোলার ব্যাপারে আমি আর আমিন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমি তো বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই থেকেছি, আর আমিন সারাদেশে কর্মসূচির সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।
গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য কর্মসূচি-সবকিছুতেই আমিন উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কাজ করতে করতে সে অনেক কিছু শিখেছে। আগে তো স্বাস্থ্য কর্মসূচি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে সে অনেক কিছু শিখে নিয়েছে এবং কর্মসূচির খুব গভীরে চলে গেছে। একজন কর্মী কী করতে পারে, কাকে দিয়ে কতটুকু কাজ করানো যাবে এবং কাকে কীভাবে শেখানো যাবে-এ বিষয়গুলো নিয়ে সে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করত এবং নিজের পরিকল্পনাগুলো ফলপ্রসূ করে তুলত।
ব্র্যাকের কর্মসূচির বিস্তার ও সাফল্য আমাদেরকে প্রবলভাবে উৎসাহী করে তুলেছিল। সাধারণত অনেকের অনেক রকম স্বপ্ন থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কর্মসূচির বিস্তার ও সাফল্যের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়-যোগ্য কর্মী নিয়োগ করতে হয়, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়-কাজে নির্দেশনা দিতে হয়, বলতে হয়-আমরা এই কাজ করব, এইভাবে করব। আমিন কর্মীদের ব্যাপারগুলো ভালো করে বোঝাতে পারত। তা ছাড়া কোনো বিষয়ে আমার চিন্তাটা সে সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারত এবং একটুও দেরি না করে তা বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। হয়তো কোনো একটা বিষয়ে আমার ভাবনার কথা আমিনকে আমি বলেছি, আমিন তখন মনে করত, যেহেতু আবেদভাই এটা ভেবেছেন, সুতরাং এর বাস্তবায়ন করতে পারলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে।
আগেই বলেছি, আমিন আর আমার চিন্তার মধ্যে অনেক মিল ছিল। আমাদের ভাবনার পদ্ধতিটাও ছিল একইরকম। আমার কাছ থেকে সে অনেক আইডিয়া পেত এবং আইডিয়া পেলেই সে তার বাস্তবায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নতুন ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে সেরা না হলেও তার বাস্তবায়নের জন্য সে ছিল সেরা। কাজ করতে গিয়ে আমিনের সঙ্গে আমার কোনো সময়ই দ্বন্দ্ব হয়নি। আমিন মনে করত যে, আমি যেটা ভেবেছি সেটা মোটামুটি ঠিক। শুধু চিন্তাধারা নয়, আমাদের দুজনের মূল্যবোধও ছিল অনেকটা একইরকম। এর ফলে আমি যেমন তার ভাবনার জগৎটাকে বুঝতে পারতাম, তেমনি আমার ভাবনার জগৎটাও আমিন চট করে বুঝে ফেলত। রাজনীতি আমরা করিনি, কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তা তো ছিল আজীবন, সেই ছাত্রবয়স থেকে সবসময়।
আমরা যখন কাজ আরম্ভ করেছিলাম, তখন অনেক রাজনীতিবিদ ভাবতেন ওরা তো বিদেশ থেকে এসেছেন, বিদেশের টাকায় কাজ করছেন, ওরা আবার দেশের জন্য কী করবেন? ওরা তো পুঁজিবাদী সমাজ তৈরি করবেন। আমিন এসে বলল, রাজনীতি আমিও করেছি। গরিব লোকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এবার আসল রাজনীতিটা বুঝতে পেরেছি। এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে, কীভাবে দরিদ্র জনগণকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হয়। আমরা তো এখন আসল রাজনীতি করছি।
আমি আমিনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শুনেছি-কেউ কেউ বলত যে, কাজে কোনো ভুলত্রুটি হলে আমিন খুব বকাঝকা করে। কিন্তু আমি তার অধস্তন কোনো কর্মীর কাছ থেকে কখনও এই অভিযোগ শুনিনি যে, আমিন তাকে অপদস্থ করেছে কিংবা কেউ তার আচরণ সহ্য করতে না পেরে পদত্যাগ করে চলে গেছে। বরং সবাই তার প্রতি অনুগত ছিল। তবে আমিনের একটা দুর্বল দিক ছিল। সব সিদ্ধান্ত সে নিজে নিত। অন্যকে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করত না। কাউকে কাজ দিলে তার সঙ্গে ক্ষমতা দিতে হয়। আমি বলতাম, তুমি যখন কাউকে কাজ দেবে তখন তাকে ভুল করার অধিকারও দিতে হবে। তুমি তো নিজেও ভুল কর। আমরা সবাই ভুল করি। আমি একজনকে কাজ দিলাম আর সে কোনো ভুল করবে না, এ তো হয় না। তাই তোমাকে অন্যের ভুল সহ্য করতে হবে এবং কর্মী তার ভুল থেকে যাতে শিক্ষা নেয়, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে।
ব্র্যাকে আমিনের উত্তরাধিকার দীর্ঘসময় ধরে থাকবে বলে আমি মনে করি। কারণ ব্র্যাকে সে অনেকগুলো কর্মধারা তৈরি করে দিয়ে গেছে। ব্র্যাকের কর্মীরা কর্মঠ ও পরিশ্রমী, এর কিছুটা হয়েছে আমিনকে দেখে। এখনও আমাদের ছেলেমেয়েরা সকাল সাতটায় উঠে গ্রামে যাচ্ছে। এটা তো ব্র্যাকে তৈরিই হয়েছে আমিনের তত্ত্বাবধানে। আমিন কতগুলো কাজকে রুটিনের মতো করে দিয়ে গেছে। তার মধ্যে একটি হলো, সকাল সাতটায় উঠে গ্রামে চলে যাওয়া। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এখনও ব্র্যাকের কর্মীরা যেভাবে কাজ করে, অন্যকোনো সংস্থার কর্মীরা সেভাবে করে কি না তা আমি জানি না। বস্তুত ব্র্যাকে যে কর্মচঞ্চলতা তার নেতৃত্ব দিয়েছিল আমিন এবং তা এখনও চলছে।