আগামী ২রা অক্টোবর আমিন ভাইয়ের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমিন ভাই ১৯৭৫ সালের ১লা এপ্রিল কর্মসূচি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ব্র্যাকে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ব্র্যাকের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেছিলেন। তাঁকে স্মরণ করে আফসান চৌধুরীর লেখা ‘আমিনভাই : সমবেত কণ্ঠস্বরের প্রতীক’ পুনর্মুদ্রিত হলো। লেখাটি ‘মাঠের মানুষ’ নামক বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাক সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া মানে এক ধরনের বহুমাত্রিকতার সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হওয়া। যাঁরা সবাই মিলে ব্র্যাককে গড়েছেন বহুকাল ধরে, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ভাবনা ও মতামত রয়েছে এর উদ্দেশ্য ও গঠনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে। অতএব একটি চিত্র দিয়ে ব্র্যাক বোঝা বা বোঝানো সম্ভব নয়। বহু কণ্ঠস্বর থেকে যে ধ্বনি আসে তার সমবেত উচ্চারণ যখন আমরা শুনতে পাই সেটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্র্যাক। আমিনভাইকে আমার এই সমবেত কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবেই মনে হয়েছে। তিনি কেবল ব্র্যাকের প্রধান কর্মসংগঠক ছিলেন না, তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন ব্র্যাক বলতে কোন ধরনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপস্থিত হয়। এসব কিছু মিলে-একইসঙ্গে বিবিধ এবং একক হচ্ছে ব্র্যাক। এর মধ্যে আমিনভাইয়ের সঙ্গে আবেদভাইয়ের সম্পর্কটা আবার আলাদা মাত্রার। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দুই প্রধান কারিগর আশ্চর্যজনকভাবে একটি সফল সম্পর্কের মিশ্রণ।
মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবা
১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশে সমাজসেবা খাতে প্রভূত অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এর একটি কারণ তো অবশ্যই যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্বাসন একটি বড়ো দাবি ছিল, যেটা পূরণ করার জন্য অনেক সংস্থা এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে কেউ পেশাদার, কেউ সরকার-প্রসূত আর কেউ কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। প্রতিটি সংস্থারই আলাদা শক্তি ও দুর্বলতা ছিল। কিন্তু এই দায়িত্ব পালন ছিল ঐতিহাসিক। এই ঐতিহাসিক ভূমিকার ক্ষেত্রে অনেকের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে ব্র্যাকও। সেই অর্থে ব্র্যাক একটি ঐতিহাসিকতার অংশ, যার সূত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
আমরা যদি স্বাধীনতাপরবর্তী প্রধান সমাজকর্মীদের নামের তালিকার দিকে তাকাই তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার হবে। আবেদভাই, অধ্যাপক ইউনূস, খুশি কবির আপা, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাই, কাজী ফারুক প্রমুখ-তাঁদের সবার মধ্যে একটি সূত্র কাজ করেছে, সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। অর্থাৎ এঁরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধে যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারই পরবর্তী প্রকাশ ঘটে এই সমাজকর্মে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চোখ দিয়ে। সুতরাং যুদ্ধের বছরে যে আলো জ্বলেছিল এবং এত মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তার শেকড় ছিল এ দেশের মাটিতেই। যে নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যায় তার জলের শেষ গন্তব্য কৃষকের লাঙলের মাটির নিচে। সেই সূত্রই বাংলাদেশের সমাজসেবা খাতকে এতটা সবল করেছে। এ কারণেই এই খাতটির জন্মসূত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ।
তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জাকায়া কিকওয়েতের সঙ্গে আমিন ভাই ও আবেদ ভাই
রাজনীতি থেকে সমাজসেবা
ব্র্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার পরিচিতি ও প্রসার ঘটে ষাটের দশকের পশ্চিমা দুনিয়ায়, যেখানে তিনি ছাত্র ছিলেন। এই সময়ে অনেকের মতো অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি লাতিন আমেরিকার বামপন্থি দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরির ‘নির্যাতিতের পাঠ্যক্রম’গ্রন্থের ভাবনা দ্বারা খুবই প্রভাবিত হন। মেট্রোপলিটন বামপন্থার ব্যর্থতা পৃথিবীর বহু মানুষকে আলোড়িত করেছিল ওই সময়ে। দীর্ঘদিন ধরে যেটা অনেকেই মনে করেছিল সমাধান, সেটি আর তখন ধোপে ততটা টিকছিল না। সেই কারণে আদর্শের যে জায়গাটা কেবল মার্কসবাদ দখল করেছিল সেটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আরও বিভিন্ন ভাবনা ও বিশ্লেষণ তখন পশ্চিমা দুনিয়ার প্রসার লাভ করছে। তার মধ্যে ফ্রেইরির এই ভাবনা একটি। আবেদভাইসহ অনেকেই এই চিন্তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠা ও গঠনপ্রক্রিয়ায় এই ভাবনা মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল, যদিও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বাস্তবতা প্রধান হয়ে ওঠে।
যে সূত্র আবেদভাই ও আমিনভাইকে একত্রিত করেছিল সেটি হচ্ছে মার্কসবাদ। আবেদভাই বিলেতে থাকাকালে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক। তাঁর মনে হয়েছিল, এরা কথা বেশি বলে, কাজ করে সেই তুলনায় কম। এ ছাড়া তৎকালীন পশ্চিমা দুনিয়ায় মার্কসবাদের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। তাঁর মতো একজন মানুষ যিনি ‘কর্মেই পরিচয়’ভাবনায় বিশ্বাস করেন, তার জন্য এমন তাত্ত্বিক কাজের প্রতি বেশিদিন আগ্রহ থাকার কথা নয়।
মার্কসবাদের সঙ্গে আমিনভাইয়ের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি দেশীয় রক্ত-মাংসের। তিনি এই ভাবনার বুদ্ধিজীবী বা পথযাত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। কিন্তু আমিনভাই ধাক্কা খেলেন ১৯৭১ সালে, বামপন্থিরা যখন ইতিহাসের সফল পাঠ ও প্রয়োগে ব্যর্থ হয়। এর ফলে এই ধারার রাজনীতিও একটি বিশাল দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেটা অতিক্রম করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।
১৯৭১ পরবর্তীকালে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয় যেখানে আদর্শিক ভবিষ্যৎ অনুপস্থিত। সেই কালে বহু মাওবাদী-মার্কসবাদীর মতো আমিনভাই বেছে নিলেন সমাজকর্ম। তাঁদের অনেকে কাছে বাস্তবতাটা ছিল এমন যে, রাজনীতি বা তার আদর্শ ব্যর্থ হলেও মানুষ ব্যর্থ নয়। তাই তাঁরা মানুষের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে। সেই অর্থে আমিনভাইয়ের ব্র্যাকে আগমন ছিল প্রধানত একটি আদর্শিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের সেবার বদলে তিনি সমাজসেবামূলক কর্মকে বেছে নেন। এই অবস্থাতেই ব্র্যাকের যাত্রা ও অগ্রগতি শুরু। আবেদভাই ও আমিনভাই দু’জন মানুষই ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের দাবি নিয়ে রাজনীতির পরিসরে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত পরিসরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা নিজেদের নতুন ঠিকানা গড়তে চেয়েছেন। সেই অর্থে ব্র্যাক একটি আদর্শিক প্রতিষ্ঠান।
শিশুদের সঙ্গে আমিন ভাই
সহযোগ
আমিনভাইয়ের প্রথম দিকের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে, ব্র্যাক যেন একটি সদ্য স্বাধীন দেশের ছোটোখাটো সংস্করণ। অর্থাৎ এখানে দেশের জন্য সমস্ত কিছু ত্যাগ করার আগ্রহ নিয়ে আসতে হবে, কাজ করতে হবে সংগঠনের জন্য। আমিনভাইয়ের আবেগ, শৃঙ্খলা, দায়বোধ ও ব্যক্তিজীবনের ওপরে কাজকে গুরুত্ব দেওয়া একটি আদর্শিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে সম্ভব নয়। আলাপ করতে গিয়ে আমার দু’টি সংস্থার কথা বারবার মনে হয়েছে; এক. কোনো বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি আর দুই. কোনো বৌদ্ধ সংঘ। এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই যেন ব্র্যাকের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। সেই অর্থে পশ্চিম এসে পূর্বকে দখল করেনি বরং আত্মস্থ হয়েছে একটি বিশাল ঐতিহ্যের মর্মমূলে।
আমিনভাইয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রগাঢ় মাহনুভবতার কথা শুনি। যে মানুষকে বাইরের মানুষ কেবল একজন কর্মী হিসেবে দেখেছেন, সেই মানুষ কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের কাছে অন্যরকম। তাদের ভালো-মন্দে তিনি আছেন, সাহায্য করেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে কাজকর্মের ব্যাপারে তিনি কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। যে একাগ্রতার সঙ্গে আমিনভাই ব্র্যাক গঠনের জন্য কাজ করেছেন সেই একই মানুষের এত সহানুভূতিশীল হওয়াটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। একজন কর্মী এবং অভিভাবকের আশ্চর্য এক সমন্বয় আমিনভাইয়ের মধ্যে দেখা যায়।
আবেদভাই ও আমিনভাই আলাদা ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তি, তবে তাঁদের কাজ দু’জনকে এক করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার চোখে এই সম্পর্কটা জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু একে যদি পূর্বের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করা যায় তাহলেই বোঝা যাবে, ব্র্যাকই হচ্ছে বাস্তবতা, যার অংশ হিসেবে আবেদভাই, আমিনভাই এবং অন্য কর্মীরা উপস্থিত। সেই কারণেই কোথায় আবেদভাইয়ের শেষ এবং কোথা থেকে আমিনভাইয়ের শুরু-এই প্রশ্ন অবান্তর। কারণ সবাই একই বাস্তবতা ও সত্যের অংশ।
আমিনভাই সম্পর্কে নানাজনের নানা মত এবং সেটাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কারও কাছে তিনি স্বাপ্নিক, কারও কাছে কর্মী, কারও কাছে একটি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরা মানুষ। সবগুলোই সত্য এবং একটি বিরাট সংগঠনের জন্মের ও বেড়ে ওঠার এবং প্রাপ্ত বয়সের ইতিহাস জানার জন্য সহায়ক। প্রথম দিনগুলোতে যখন তিনি মাঠেঘাটে কাজ করে বেড়াচ্ছেন আর শেষের দিনগুলোতে যখন ব্র্যাক প্রসারিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, এই দুই বাস্তবতাকে এক করে তিনি কাজ করেছিলেন। সেই অর্থে এসব বাস্তবতা মিলে ইতিহাস এবং এই ইতিহাসের একটি অংশ তিনি সবার সঙ্গে।
বাংলাদেশের গহিন গ্রামে দাঁড়িয়ে যুদ্ধফেরত মানুষের বিধ্বস্ত বাস্তবতা সব পশ্চিমা তত্ত্বকে হার মানিয়ে আবেদভাইয়ের কাছে ছিল ব্র্যাকের ব্রাহ্ম মুহূর্ত। হয়তো তিনি পুরোটা টের পাননি। কিন্তু ব্র্যাকের সক্রিয়তা, পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতা এবং মানুষের প্রয়োজনে বিশালতা অর্জনের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অবলোকনের অভিজ্ঞতায়। ঠিক তেমনিভাবে আমিনভাই এসেছিলেন একটি বিপর্যস্ত রাজনৈতিক ভাবনার অঙ্গন থেকে, যা ক্রমেই অবলুপ্ত হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর ভেতর যে ক্ষমতাটা ছিল সেটা হচ্ছে নতুন বাস্তবতাকে ধারণ করার। আমিনভাই সেটি করেছিলেন।
বিপ্লবী রাজনীতির পরিণতি বিপ্লবী সমাজকর্মের, যার প্রভাব আজ বিশ্বব্যাপী। সেই ইতিহাসের আমিনভাই একজন প্রধান কারিগর। কিন্তু শেষ বাস্তবতা হচ্ছে, চূড়ান্ত সাফল্য আসে সেই সাধারণ মানুষের মাধ্যমে যাদের সেবা করার জন্যই ব্র্যাকের জন্ম। এই প্রক্রিয়া শেষ হয় না, সবাইকে সঙ্গে নেয় কিন্তু কাউকে মনে রাখে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়া একটি সমাজকে, জাতিকে, জনগোষ্ঠীকে মনুষ্যত্ব দেয়। আমিনভাই এই প্রক্রিয়ার অংশ, আবেদভাইও তাই। তাঁদের সহকর্মীরা এই প্রক্রিয়ার অংশ। নিষ্ঠুর কিন্তু চমকপ্রদ এই বাস্তবতা আমিনভাই সম্ভবত বুঝতেন। সেবার মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া, ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাওয়া হচ্ছে সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এই মিশে যাওয়া মানুষকে স্বাধীনতা দেয়, যেমন দিয়েছিল আমিনভাইকে।
আফসান চৌধুরী ইতিহাসবিদ, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী ও ব্র্যাকের সাবেক পরিচালক। এক সময় বিবিসি ও ইউনিসেফ-এ কাজ করেছেন। একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত রয়েছেন।
চমৎকার বিশ্লেষণ আফসান ভাই, ১৯৭১, সাধারণ মানুষের জন্য টান নিয়ে কাজ করে তাদের জীবন মান উন্নয়ন করা সে তো আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের ই এক নিভৃত অথচ অনস্বীকার্য ইতিহাস।