উঠে বসলাম এক ডিঙি নৌকায়। পশুর নদীর বুক চিরে তির তির করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাটি। সব মিলিয়ে যাত্রীর সংখ্যা দশ কি বারো জন। এই নৌকার বিশেষত্ব হলো যাত্রীরা সবাই যাচ্ছেন পানি আনতে। খাবার পানি আনতে তাদের এই যাত্রা!
এক গ্লাস পানি চাই, বিশুদ্ধ খাবার পানি।
হাতের কাছেই রাখা থাকবে পানি ভরা জগ, আছে গ্লাস; পানি পানে বাধা কোথায়? আমি জানি, এতটুকু পড়ে অনেকে হয়তো আমার মতোই মনে করছেন। কিন্তু অন্য এক অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে। আজ বলতে চাই তাদের কথা, আমাদের দেশেরই সাধারণ জনগণ, যারা পানির জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দিচ্ছে প্রতিদিন।
মোংলার চিলাবাজার গ্রাম। সুন্দরবনের কাছেই এর অবস্থান। আমি গিয়েছি সেখানে একটি ভিডিও-র কাজে। উঠে বসলাম এক ডিঙি নৌকায়। পশুর নদীর বুক চিরে তির তির করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাটি। সব মিলিয়ে যাত্রীর সংখ্যা দশ কি বারো জন। এই নৌকার বিশেষত্ব হলো যাত্রীরা সবাই যাচ্ছেন পানি আনতে। এর সাথে আরও একটি বিষয় যোগ করতে চাই, নৌকার যাত্রীরা সবাই নারী, কেননা দেশ-গ্রামে দেখা যায় দূর থেকে পানি আনার কাজটা সাধারণত বাড়ির মেয়ে বা মায়েরাই করে থাকে।
একই গ্রাম থেকে তারা সবাই রওনা হয়েছেন, সবার সাথেই আছে কলসি। অনেকে আবার কলসির ওপরে বসানো যায় এমন হাড়িও সঙ্গে নিয়েছেন। মানে, যতটা বেশি পানি ভরে আনা যায় সেই চেষ্টা। তাদের মধ্যে থেকেই কম বয়সি কয়েকজন পালাক্রমে নৌকা বাইছেন। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে নৌকা। বলতে দ্বিধা নেই নৌকা দুলে উঠলে ভয় পাচ্ছি কারণ, আমি সাঁতার জানি না। তারপরও তাদের সাথে কিছুটা কাজের, কিছুটা সাধারণ কথাবার্তায় কেটে গেল ঘণ্টাখানেক। এবার আমাদের নৌকা ভিড়ল এক ঘাটে। অন্য সবার সাথে আমিও নেমে পড়লাম নৌকা থেকে, এবার নাকি হাঁটার পালা।
ছবি- লুবা খলিলি
দশ থেকে পনেরো মিনিট হাঁটার পর এক পুকুর ঘাটে পৌঁছলাম। এখান থেকেই নেওয়া হবে খাওয়ার পানি। আমি হাতের তালুতে একটু পানি নিয়ে মুখে দিলাম। আমার কাছে তো পানির স্বাদ লবণাক্তই মনে হলো। কিন্তু তারা বলল, এটাই কম লবণাক্ত পানি তাই খাওয়া চলে। সবাই সঙ্গে করে আনা খালি অ্যালুমিনিয়ামের কলসি, হাঁড়ি-পাতিলে পানি ভরে নিচ্ছে। তাদের মধ্যে একটু তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করলাম, বুঝলাম আবার ফেরার তাড়া আছে। আমার চোখে ভাসছে তখন বাড়ির টেবিলে রাখা জগ; যেখান থেকে আমি চাইলেই বিশুদ্ধ খাবার পানি পেয়ে যাই।
দু কলসি পানি আনতে সময় ব্যয় হয় দু ঘণ্টার বেশি! একবারে যেটুকু পানি আনা হয় তাতে অনেকের বাসাতেই পানির টান পড়ে। তাই বেশিরভাগ সময়ই দিনে দুবার এভাবে আসা-যাওয়া করতে হয়। মনে হলো, শুধু এত সময় লাগে বলেই হয়তো এখানকার মেয়েরা অন্য অনেক গঠনমূলক কাজে সাথে সহজে যুক্ত হতে পারে না।
মোংলার উপকূলবর্তী গ্রামগুলোর অবস্থা এমনই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেখানে নলকূপ স্থাপন করা অনেক ব্যয়বহুল। খাল বা পুকুরগুলোতে জোয়ারের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় তা পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। নোনা পানিতে কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া কিংবা গোসল করা গেলেও খাবার পানির জন্য তাদের ছুটতে হয় দূরের কোনো গ্রামে।
একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে সমুদ্রতটের মানুষের এই জীবন সংগ্রাম আমার জন্য বড়োই পীড়াদায়ক। প্রত্যেকের নিরাপদ জীবন ও জীবিকা নিশ্চিতে এখন প্রয়োজন একটি টেকসই সমন্বিত উদ্যোগের। এখনই প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বর্ষাকালে খানিক আরাম হয় বাড়ির মেয়েদের। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে তারা। সাধারণত বৃষ্টির পানি মটকায় ধরে রাখে। মটকা হলো বড়ো মাটির পাত্র। ধান-চাল মানে নানা ধরনের শস্য তাতে সংগ্রহ করে রাখা হয়। এ অঞ্চলে ঘরের চালের নিচে মটকা রেখে দেওয়া হয়। বৃষ্টির পানি ঘরের চাল থেকে গড়িয়ে মটকায় পড়ে। সেই পানি ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে নেয় তারা। আবার দেখা যায় যেসব পুকুরের পানি অন্যসময় লবণাক্ততার জন্য খাওয়া যায় না তা বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের কারণে কিছুটা কমে। তখন সেই পানিই ব্যবহার করে।
স্থানীয় এই উদ্যোগকে আরেকটু এগিয়ে দিয়েছে ব্র্যাক। যারা টাকার অভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ট্যাংক কিনতে এবং তা বিশুদ্ধ করার উপযুক্ত উপায় করতে পারছেন না, তাদের বাড়ি বাড়ি ২০০০ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পানির ট্যাংক স্থাপন করে দিচ্ছে ব্র্যাক। সেইসাথে ট্যাংকের ওপর বিশেষ পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টারও বসিয়ে দিচ্ছে। ব্র্যাক সবাইকে এ ব্যাপারেও উৎসাহিত করে যে, আজ একজনের বাড়িতে সংগ্রহে থাকা পানি না থাকলে অন্যজন তাকে পানি দিয়ে সহায়তা করবে।
শেষ করি অন্য একটি গল্প দিয়ে-
লক্ষ্মী মণ্ডলের কথা। নদীর কূল ঘেঁষে তার বসতভিটা। গতবছর বাড়ির আঙিনা থেকে বেশ খানিকটা দূরে নৌকা ভিড়িয়ে অনেকখানি পথ পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে। তখন তার উঠোনজুড়ে ছিল বিভিন্ন রকমের গাছপালা আর শাকসবজির বাগান। উঠোনের চারপাশ ঘুরে ঘুরে তার সাথে কথা বলেছিলাম। এক বছর বাদে এই সেদিন আমি আবার কাজের ফাঁকে লক্ষ্মী দিদির খোঁজে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তার বসতভিটার কাছাকাছি পৌঁছিয়ে আমি অবাক! জোয়ারের পানিতে তার উঠোনের অর্ধেকটা ডুবে গেছে। আগেরবার যেখানে লক্ষ্মী দিদির সাথে হেঁটে হেঁটে কথা বলেছিলাম, এবার গিয়ে দেখি সেখানে হাঁটুপানি। মনে মনে শঙ্কিত হলাম, আগামী কয়েক বছর পরে গেলে হয়তো দেখব লক্ষ্মী দিদির বাড়িটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অনুলেখক- সাব্বির আহমেদ ইমন
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
ছবি- বায়েজিদ ইসলাম পলিন, সাদিকুর রহমান