“আমি বাড়ির ছোটো সন্তান। বাড়ি ছেড়ে আসায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। এমনকি বাসা ছেড়ে প্রথম যেখানে গেলাম, সেখানেও প্রথম প্রথম আমাকে কেউ মেনে নিতে চায়নি। একদিন আমার সব কথা শুনলেন গুরু মা। শুনে খুবই স্নেহের সাথে বললেন আমি তো তাদেরই একজন, যে কোনো প্রয়োজনে তারা আমার পাশে আছে। এরপর থেকে সবার সাথে ‘কালেকশনে’ যাওয়া শুরু করলাম। দিনশেষে খাওয়া-দাওয়া এবং অন্য সবকিছুই আমরা নিজেরা একসঙ্গে মিলেমিশে করতাম।”
আমি কখনও করুণা চাই না, কারও করুণা নিতেও আমার ভালো লাগে না। যে কারণে আমার সম্প্রদায়ের অন্যদের সাথে আমি ‘কালেকশনে’ খুব একটা যেতে চাইতাম না। আমি আমার নিজের এবং আমার সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের একটি সম্মানজনক জীবনের স্বপ্ন দেখি।
“বাবা-মায়ের সাথে গত ১২ বছর ধরে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যেটুকু এগোতে পেরেছি, পুরোপুরি আমার নিজের চেষ্টায়।”
ছোটোবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে খেলতে ভালো লাগত। ছেলেরা এই বিষয় নিয়ে অনেক বিরক্ত করত, বাজে মন্তব্য করত। কিন্তু শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন।
আমার ইচ্ছা করত শাড়ি পরতে, তাই সুযোগ পেলে চাচিদের কাছে আবদার করতাম, তাদের শাড়ি পরতাম। বাবা-মা এটা সহ্যই করতে পারতেন না, অনেক মারধর করতেন। আমার মেয়েলি স্বভাবের কারণে বাবা-মা নাকি বাইরে মুখ দেখাতে পারছিলেন না। তারা আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখনই আমি বের হয়ে যাই, হিজড়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিই।”
আমি কক্সবাজার সদরে থাকি। হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন এখানে আছে। আমিও এরকম একটি সংগঠনের সাথে জড়িত। কক্সবাজারেই মূলত এই সংগঠন কাজ করে। একদিন আমাদের ঐ সংগঠনের অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। সেদিন আমার সঙ্গে রিনা আপার (কামরুন্নাহার রিনা, ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রোগ্রাম অর্গানাইজার) প্রথম দেখা হয়। তার সঙ্গে আলাপে জানতে পারলাম যে আপা ব্র্যাকে কাজ করছেন, তাও আবার অবহেলিত, আয়-উপার্জনহীন মানুষদের নিয়ে। তিনি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন জেনে আমি ওনার সাথে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করি। প্রশিক্ষণ দিয়েই তো আমার জীবনের উন্নতির শুরু হতে পারে।
রিনা আপা আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর আমাকে তিনি ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন আমি দর্জির কাজ করতে পারব কিনা, আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি পারব। আমার অনেক আগে থেকেই এই কাজ শেখার শখ ছিল, কিন্তু সবাই তো অবহেলা করত- তাই কাউকে বলারও সুযোগ হয়নি যে আমি এই কাজ করতে চাই।
আমি সরকারি স্কুলে পড়তাম, সেখানে ছেলেমেয়ে সবাই পড়ত। কিন্তু আমি ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম না। একদিকে বাসায় সারাক্ষণ রাগারাগি, আর অন্যদিকে স্কুলে ছেলেরা এত বিরক্ত করত যে যখন আমি বাসা ছেড়ে চলে যাই, থাকতে শুরু করি আমার গুরু মা’র সাথে; তখন পড়ালেখাও ছেড়ে দেই। আমার স্কুল জীবন ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই।
আমি বাড়ির ছোটো সন্তান। বাড়ি ছেড়ে আসায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। এমনকি বাসা ছেড়ে প্রথম যেখানে গেলাম, সেখানেও প্রথম প্রথম আমাকে কেউ মেনে নিতে চায়নি। একদিন আমার সব কথা শুনলেন গুরু মা। শুনে খুবই স্নেহের সাথে বললেন আমি তো তাদেরই একজন, যে কোনো প্রয়োজনে তারা আমার পাশে আছে। এরপর থেকে সবার সাথে ‘কালেকশনে’ যাওয়া শুরু করলাম। দিনশেষে খাওয়া-দাওয়া এবং অন্য সবকিছুই আমরা নিজেরা একসঙ্গে মিলেমিশে করতাম।
এভাবেই দিন কেটে যেতে থাকল। সম্প্রদায়ের সবাই যা আয় করত, তার থেকেই আমার খাওয়া-পরা হয়ে যেত। ২০১৮ সালে আমার ভাই আমার খোঁজ করেন, আমার সাথে যোগাযোগ করেন। আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বলেন। এর ছয় মাস পর আমার ব্র্যাকের আপা’র সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
আমি তখন বই পড়তাম, আর অনেক কাঁদতাম, কোথা থেকে কই চলে এসেছি। আমার বয়স যখন ১৮, বাসা থেকে জানতে পারে আমি হিজড়া কমিউনিটির সাথে থাকছি এবং আমার ভাই আমাকে খুঁজে আবার বাসায় নিয়ে যান। তবুও বাবা, মা, বোন, ভাবী মেনে নিত না। যেহেতু আমার ইচ্ছা নিজের মতো একটা সম্মান নিয়ে বাঁচার, তাই আমি মনোযোগ দিয়ে ট্রেনিং নিতে থাকি । কেউ যেন হেয় চোখে না দেখে, কেউ যেন আমার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে না পারে, সেই চিন্তা থেকেই ট্রেনিং নেয়া।
ভাটিয়ালিতে আমরা ৫২ জন থাকতাম। এখনও অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে যাদের সাথে ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছি। তারা বিভিন্নজন বিভিন্ন কাজ করে, কিন্তু খুব সম্মানজনক কিছু নয়। মহামারিতেও অনেকের সাথে কথা হয়েছে, তাদেরকে আমি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলি, সচেতন থাকতে বলি। কয়েকজন ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। লকডাউনের সময় অনেকেই ঠিক মতো খেতে পর্যন্ত পারত না বলে খবর পেয়েছি। ব্র্যাক থেকে তাদের কয়েকজনকে সহায়তাও দেয়া হয়েছিল।
এই যে দোকানে আমি কাজ করি, সেখানেও কাস্টমাররা আসলে এখন আমরা সচেতনতা মেনে চলি। লকডাউনে কিছু সময় দোকান বন্ধ ছিল, আর মাঝে মাঝে দোকান বাইরে থেকে বন্ধ রেখে ভিতরে আমরা কাজ করতাম। সবাইকে বারবার সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছি, কারণ আমাকেও সবাই একই পরামর্শ দিয়েছেন। হাত ধোয়া, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরা, ঘরে প্রবেশ করার পর আগে গোসল করা- সবাইকে এই কাজগুলো করার পরামর্শ আমি এখনও দিই। যাদের সাথে একত্রে ট্রেনিং নিয়েছিলাম তাদেরও খোঁজ নিয়েছি, নিরাপদে থাকতে বলেছি।
আমি ভবিষ্যতে নিজে টেইলরিংয়ের দোকান দিতে চাই, আমার মনের মতো করে দোকান সাজাতে চাই। আমার সম্প্রদায়ের অন্যদেরও এই কাজে আমি আনতে চাই, তাদের কাউকে বিপথে যেতে দিতে চাই না। আমার কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে চিন্তা করি, সবসময় আমার মাথায় কাজ করে কীভাবে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা যায়।
আমি চাই আমার মতো আরও ট্রান্সজেন্ডার লার্নারদের এরকম বিভিন্ন পেশায় নিয়ে আসব। তাদেরকে আমি নিজেই কাজ শিখাব এবং চাকরি দিব।
এই মহামারির মধ্যে আমার আয় কিছুটা তো কমেছেই যেহেতু লকডাউন ছিল, মানুষের হাতে কাজ নেই, অর্ডারও নেই। তবুও আমি নিজে ঘর ভাড়া দিয়ে এখন নিজের মতো থাকছি। রিনা ম্যাম আছেন, পরিচিত অনেকেই আছেন- তারা সবাই আমাকে ভালো করে কাজ করতে উৎসাহ দেন।
ব্র্যাকের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আমাকে আমার ভবিষ্যৎ গড়ার পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
আমার বাবা, মা, বোন, ভাবী কেউ এখনও আমাকে মেনে নেয়নি, মেনে নিতে পারেনি। সমাজই তো পারেনা, তাদের দোষ দিয়ে কী লাভ? ভাই সাপোর্ট করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেও এখন অসুস্থ। তাই বাসা ভাড়া নিয়ে আমি নিজেই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিই।
সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।”
মানুষের অধিকার রক্ষায় গত প্রায় ৫০ বছর ধরে নিরলস কাজ করে চলেছে ব্র্যাক। বৈষম্য, সহিংসতা, অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে ব্র্যাকের এই লড়াই অব্যাহত থাকবে, সবার জন্য সুন্দর একটি পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্ন থাকবে অটুট।
কক্সবাজারে ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি (এসডিপি) থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মনীষা (রহিম) যে দোকানে এখন কাজ করছেন, সেখানে বসেই তার সঙ্গে আমাদের কথোপকথন হয়। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
সম্পাদনা এবং সহযোগিতায়- তাজনীন সুলতানা, তাসনীম মাহবুবা রহমান, মোঃ খালেদ মাহমুদ
Wishing a good journey ahead. nicely written,
তাদের জীবন সংগ্রামের কথা চিরকাল দেয়াদের ওপরেই রয়ে গেছে । আমরা মুখোশধারী সভ্য জাতির কখনো জানতে চাইনি সেই না বলা জীবন যুদ্ধের কথা । ধন্যবাদ আপনাদের কে , তাদের জীবন সংগ্রামের কথা তথাকথিত সভ্য জগতের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ।