কৃষ্ণাদির এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, সারাদিন কিস্তির টাকা তুলে সাইকেল নিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ঘাটে গিয়ে দেখেন নৌকা রেখে মাঝি চলে গেছে। অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া গেল না। অথচ মাঝি জানেন এ পথেই ফিরবেন তিনি। এই দুর্যোগে কোনো মানবিকতাই দেখাল না সে।
কৃষ্ণাদি তখন এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। নৌকা চালানো একটু-আধটু জানতেন, নদী তো পার হতেই হবে, অগত্যা কাদাপানি ঠেলে বহু কষ্টে সাইকেলটি নৌকায় রেখে হাতে তুলে নিলেন বৈঠা। নৌকা বাইতে গিয়ে দেখা গেল তিনি যাবেন ‘বাহির চর’ কিন্তু স্রোতের টানে চলে গেছেন অন্য এক ঘাটে। কী যে কষ্ট করে সেদিন অফিসে ফিরেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা …
মশিউর (ছদ্মনাম) জেলা শহরে থাকেন। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আঞ্চলিক কর্মকর্তা। স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং মা-বাবাকে নিয়ে ভালোই আছেন। তাদের পরিবারে খুব সাধারণ একটি দৃশ্য হলো, তিনি বাসায় ফিরে আবার অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সত্যি বলতে, তিনি তা করতেও ভালোবাসেন। এটা তো স্বাভাবিক যে, কাজের সময় অন্য কেউ কথা বলতে থাকলে বিরক্ত লাগে। এমনটা প্রায়ই হতো যে, বাসায় বসে কাজ করার সময় কেউ ঘরে ঢুকে কথা বললেই সে তাদের কথা শুনত না, বরং ‘পরে হবে’ বলে চলে যেতে বলত। একদিন-দুদিন করতে করতে মশিউর ভাইয়ের এটাই স্বভাব হয়ে গেল। সবাই মোটামুটি জেনে গেল তার সাথে সব কথা বলা …
সুচিত্রা রানি মণ্ডল। তার সঙ্গে আমাদের ফসলের মাঠে দেখা। কেজি কেজি ধানের গোছা মাথায় নিয়ে দিব্যি হেঁটে চলেছেন। এত ভারী বোঝা নিয়ে চলছেন কিন্তু চেহারায় তার প্রকাশ নেই। খুশি মনে কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অবলীলায়। নিজের খেতে যখন ভালো ফসল হয় তখন সেই আনন্দ আসলে সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়।
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার এক গ্রামে সুচিত্রা থাকেন স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। স্বামী দিনমজুরের কাজ করে। একার আয়ে সংসার চলে না তাই সুচিত্রাও তার সাথে ফসলের মাঠে কাজ করতে শুরু করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এখন অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করেন।
সুচিত্রার কাজটা ভীষণ পরিশ্রমের, জমি চাষ থেকে শুরু করে সবই তো করছেন। নিজ …
জাহানারা তার মরিচগাছের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ব্র্যাকের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকে গেলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কোঁকড়ানো পাতাসহ মরিচগাছের একটি ডাল। দেখাতে হবে কী হাল হয়েছে তার গাছের! তা না হলে ডাক্তারসাব রোগ ধরবেন কীভাবে?
একটু একটু করে পাতাগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন পোকা ধরেছে, বাজার থেকে যা হোক একটা ওষুধ কিনে দিলেই হলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না।
একসময় খেতের সবগুলো গাছ আক্রান্ত হলো। এবার জাহানারার কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ফসল নষ্ট হলে চলবে কেমন করে? একদিন শোনেন, গ্রামে ব্র্যাকের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকের লোকেরা আসবে। মাইকিং করে বলা হচ্ছে, চাষাবাদ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে সেখান গিয়ে পরামর্শ …
আর্থিক টানাটানি কিছুটা থাকলেও ৪০ বছর বয়সী রহিমা (ছদ্মনাম) স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু যেন সবকিছু ওলটপালট করে দিল। এরপর থেকে একে একে নানা খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন নারী, এমনিতেই জীবনে চ্যালেঞ্জের কোনো শেষ থাকে না, এর সাথে তার জীবনে যোগ হয়েছিল সন্তানদের সবার মুখে আহার জোগানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না।
সিলেটের মেয়ে রহিমা। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই অল্প বয়সেই তাকে এক দিনমজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। সেখানে টানাটানি থাকলেও স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল ভালো। একে একে তাদের পরিবারে আসে তিন সন্তান।…
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রাম সোহাগপুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত থেকে এই পথেই অনেক মুক্তিযোদ্ধা দেশে প্রবেশ করে অপারেশন চালাতেন। সোহাগপুরের অনেকেই তখন গোপনে তাঁদের জন্য খাবার আর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন।
আক্রোশ থেকেই পাকস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা এই গ্রামে হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই এই গ্রামের ১৮৭ জন নিরস্ত্র মানুষ শহীদ হন। নির্যাতনের শিকার হন অনেক নারী। সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ মারা যায়। সে কারণেই স্বাধীনতার পরে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘সোহাগপুর বিধবাপল্লি।
মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে সোহাগপুর গ্রামে যারা …
গত ১১ই জুলাই পালিত হলো বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনসংখ্যা তো স্রেফ পরিসংখ্যান বা গাণিতিক সংখ্যা নয়, বরং আধুনিক সমাজে জনসংখ্যাকে ঘিরে অধিকার আর সমতার আলোচনা একটি প্রয়োজনীয় উন্নয়ন মাপকাঠি। এবারের জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল “জেন্ডার সমতাই শক্তি : নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন।“ এই যে জেন্ডার সমতার শক্তিকে উন্মোচন করার কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ভীষণ রকমের আশাব্যঞ্জক। নারীর অধিকার নিশ্চিত করা মানে যে বিশ্বের অবারিত সম্ভাবনাগুলোকে উন্মুক্ত করা তা এবারের প্রতিপাদ্যে উঠে এসেছে জোড়ালোভাবে।
বিশ্বের জনসংখ্যা যখন ৫ বিলিয়ন পেরিয়েছিল, সেই ১৯৮৯ সাল, তখন থেকেই জাতিসংঘ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং …
ব্র্যাকের সূচনার দিনগুলোতে সমস্ত কর্মপ্রয়াসের সঙ্গে একটি উজ্জ্বল নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল। সেই নাম আয়েশা হাসান আবেদ। অকালপ্রয়াত এই মহীয়সী নারীর নাম ব্র্যাকের অস্তিত্ব ও কর্মধারার সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ব্র্যাককর্মী এবং কর্ম-এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘ভাবী’ আর পরিবারপরিজন ও বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন ‘বাহার’। যে নামেই ডাকা হোক, অকালমৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্র্যাকের আত্মা। গভীর মমতা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আভায় তিনি ব্র্যাকপরিবারের সকলকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধেছিলেন। ব্র্যাকের উত্থানকালের সেই গতিশীল দিনগুলোতে ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পাশে। অসহায় দরিদ্র মানুষকে সংগঠিত করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্র্যাকের যে অঙ্গীকার, তারই সঙ্গে …
বাংলাদেশের অবস্থান নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলে হওয়ার কারণে এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এর তীব্রতা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে। বছর জুড়ে নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন দুর্যোগের ঘনঘটা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে করে তুলেছে কঠিন। জার্মান ওয়াচের বৈশ্বিক ঝুঁকি সূচক (জানুয়ারি, ২০২১) অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা যেন পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন সেজন্য ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি, সূর্যমুখী চাষ, উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক, বনায়নের মতো বিভিন্ন প্রকল্প। এসব উদ্যোগ …
“আমারে তো জবাই দিয়ে ফেলত! একদিন আমার স্বামী আমারে কয়- যা, তোর ভাইয়ের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা নিয়ে আয়গে; আমি অটো কিনব। আমি তখন কইলাম- আমি টাকা আনতি পারব না। তোর লাগবে তুই গিয়ে চা। তখন রাইগে গিয়ে আমার গায়ে হাত তোলে। আমার স্বামী অন্যদেরকে বলে- শুধু হাত-পা ধর; যা করার করে ফেলবনে। লোকে টের পাবে না।
ননদ, দেবর, ভাসুর আর শাশুড়ি মিলে আমার হাত পা ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। আমার স্বামী গলার ওপরে এমনভাবে চেপে বসে যে আমার জিভ বের হয়ে যায়। আমার স্বামী তখন বলছিল- এখনি জবাই করে দেই, তোর বাপ-মাও খুঁজে পাবে না! এমন সময় আমার …
সংসার জীবনের একপর্যায়ে দেখা যায় ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে নিজেদের জগৎ তৈরি করে নেয়, পরিবারের অন্যরাও নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন বাড়িতে থাকা মায়েদের ব্যস্ততা হঠাৎ করেই কমে যায়, সময় কাটানোই একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমি এ বিষয়টা নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম। এ কারণে ক্যাটারিং ব্যবসার সুযোগটা যখন এলো তখন খুব গুরুত্ব দিয়েই কাজটা শুরু করলাম।
রান্না ব্যাপারটাই এমন যে, যিনি রাঁধছেন এবং যারা খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে নিজের অজান্তেই একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হয়ে যায়। খুব ভালো লাগত যখন আমার রান্না করা খাবার খেয়ে অফিসের কর্মকর্তারা বলতেন, “আপা, আপনার রান্না খেয়ে মনে হচ্ছে মায়ের রান্না/দাদির রান্না খাচ্ছি।”
আমি ফেরদৌস ওয়াহিদা আক্তার …
না ফেরার দেশে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর মৃত্যু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন! নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও প্রস্থানের মধ্যকার সময়কে বলা হয় ‘জীবন’। সেই জীবনে কে কী করলেন, কী রেখে গেলেন সেটিই কিন্তু মূল বিবেচ্য। মহত্ত্ব ও সার্থকতা প্রতিটি মানুষের কর্মের মধ্যেই নিহিত থাকে। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝের ‘জীবন’ নামক অংশটির অবসানের মধ্য দিয়ে তিনি ধরণী থেকে বিদায় নিয়েছেন। হয়তো থেমে গেল তাঁর কর্ম, তাঁর এগিয়ে চলা। কিন্তু থেকে গেল তাঁর ত্যাগ, দেশপ্রেম, মানবসেবা এবং সত্যচারিতা, যা চিরদিন অমলিন হয়েই রইবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেধা, মনন ও কর্মে একজন মহান ও সার্থক মানুষ হিসেবেই সকলের হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে রইবেন।…