রাস্তা দিয়ে তো কত মানুষই হেঁটে যায় রোজ।
রাস্তা দিয়েই মানুষ ঘরে ফেরে, আবার ঘর হারিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজেও মানুষ রাস্তায় নামে।
হেঁটে যাওয়া প্রতিটি মানুষই তো একেকটি গল্প।
কোন গল্প সফলতার, কোন গল্প ব্যর্থতার, কোন গল্প অধিকার হারানোর, কোন গল্প অনধিকার চর্চার।
আবার কোন গল্প কারো অন্তরের গভীরে জ্বলতে থাকা কোন জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। কোন সংগঠিত আন্দোলন বা রাজনৈতিক দাবি সেখানে থাকে না। সেখানে থাকে প্রতিবাদের ডাক, প্রতিরোধের প্রত্যয় এবং প্রতিকারের আশা।
যার যার অবস্থান থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া অধিকার আদায়ের লড়াইয়েরই সামিল।
সমাজের এমনই এক লড়াকু সৈনিক মির্জা শাহজাহান। বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যিনি স্থাপন করতে চান ন্যায়বিচার আদায়ের এক বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত।
এটি একটি আক্ষেপের বিষয় যে আমাদের দেশে কেউ যখন কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে রাস্তায় নামেন তখন বিভিন্ন মহল বা অবস্থান থেকে সেই পরিবর্তনকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় তখন পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের উৎসাহে ফাটল ধরে এমন সব উপায়ে তাদের বাধা প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ পরিবর্তন যারা চান না তারা জানেন পরিবর্তন চাওয়াটা একটি মানসিক রূপান্তরের লক্ষণ যা প্রভাবিত করতে পারে পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে। তাতে স্বার্থহানি ঘটবে অনেকের।
মির্জা শাহজাহান সমাজে ইতিবাহক পরিবর্তন ঘটাতে চান। বয়স তাঁর ৬৫। সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্ম। কর্মজীবনে ছিলেন একজন উন্নয়নকর্মী।
এখন পরিবারসহ বাস করেন টাঙ্গাইল শহরে। টাঙ্গাইল শহরে তাঁর রয়েছে এক ভিন্নধর্মী পরিচিতি। তিনি একজন ‘স্বাস্থ্য সাধক’ হিসেবে পরিচিত। নিজের বাসস্থানের সামনেও ব্যানার দেখা যায়, ‘স্বাস্থ্য সাধনা কেন্দ্র’।
একসময় ধূমপান করতেন মির্জা শাহজাহান। খাওয়াদাওয়ায় থাকতো অনিয়ম, নিয়মিতই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগতেন। বয়স যখন ৫০ পেরোলো, তখন নিজেকে নিয়ে একটু নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবতে শুরু করলেন কি করে নিজেই নিজের যত্ন নিয়ে শরীরটাকে ঠিক রাখা যায়, একই সাথে তখন তাঁর মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়েও প্রশ্ন জাগলো। মানুষের অধিকার নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন।
এদেশের মানবাধিকার নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো। তাঁর মনে উদয় হলো, নারীরা সমাজে বিভিন্ন অধিকার হতে বঞ্চিত এবং এই একুশ শতকেও নারীরা পুরুষদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং নানাবিধ যৌন সহিংসতার শিকার। তাঁর মতে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন।
২৫শে আগস্ট, ২০১৭। বগুড়া থেকে বাসে ময়মনসিংহ ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হলেন ২৫ বছর বয়সী রূপা আক্তার। পাঁচজন ধর্ষক বাসে আর কোন যাত্রী না থাকার সুযোগ নিয়ে রূপার ওপর চালালেন পাশবিক অত্যাচার। এক পর্যায়ে তাকে ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে বাস থেকে ফেলে চলে যান।
পাঁচজন ধর্ষকের মধ্যে দুইজনের বয়স ৫৫ এবং ১৯। হয়ত যখন বেঁচে ছিলেন, এই বয়সী মানুষদের রূপা চাচা, মামা অথবা ছোট ভাই হিসেবেই দেখতেন।
এই ভয়াবহ ঘটনাটি ভীষনভাবে ক্ষুব্ধ এবং আহত করলো মির্জা শাহজাহানকে। সংবাদমাধ্যমে খবরটি দেখার পর থেকে কাঁদতে লাগলেন ক্রমাগত। তাঁর স্ত্রী কোনভাবেই তাঁকে শান্ত করতে পারছিলেন না। ঢাকা থেকে দুই ছেলেও ফোন করলেন, তাদের সাথেও কাঁদতেও লাগলেন। তাঁর মনে হতে লাগলো রূপা যেন তাঁরই মেয়ে যাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে মানুষরূপী কিছু পশু নির্মম অত্যাচারে মেটে উঠেছিল। অন্ধকার বাসে রূপার অসহায়ত্ব বারবারই তাঁর চোখে নিয়ে আসছিলো জল।
মির্জা শাহজাহান রুখে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিলেন। মানুষের, বিশেষ করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও সোচ্চার হবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। নারীর উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি নিজের অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
স্বাস্থ্য সাধক মির্জা শাহজাহান স্বাস্থ্য চর্চা থামালেন না। শোককে শক্তিকে পরিণত করে রূপা আক্তারের হত্যার বিচারের দাবিতে দৌড়াবার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি সাদা গেঞ্জিতে স্ত্রী সেলাই করে পেছনে লিখে দিলেন ‘রূপা হত্যার বিচার চাই’।
এ যেন নিজের আদরের মেয়ের নির্মম হত্যার বিচার চেয়ে এক বাবার বলিষ্ঠ হুঙ্কার।
আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সহস্র রূপার আর্তনাদে লেখা এই মানবাধিকার কথাটি। সহস্র নির্যাতিত, সুবিধাবঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, বাস্তুহারা, জরাগ্রস্থ মানুষের দুঃখ ঘোচাতে আমরা যদি নিজেদের অবস্থান থেকে এগিয়ে আসি মির্জা শাহজাহানদের মত, তবেই সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের পথে আমাদের যাত্রা হবে আরও গতিময়, আরও সহজ।