মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে মানসিক নিরাপত্তা কি সম্ভব?

November 26, 2017

কক্সবাজারের কুতুপালং অস্থায়ী আবাসে প্রবেশ করে আমরা যত ভেতরে যেতে থাকব, ততই দেখব মিয়ানমার থেকে আগত মানুষের জোড়াতালি দেয়া সংসার এবং মানবেতর জীবনযাপন। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর পরপরই হঠাৎ দেখা মিলবে একটি খোলা, ছায়াঘেরা, রঙ্গিন স্থান! জায়গাটি দেখে থমকে যেতে হয়। বাঁশ দিয়ে তৈরি স্থাপনা, ভেতরে হাতে তৈরি কিছু সাজসজ্জা ঝুলছে দেয়াল জুড়ে। বাইরে থেকে প্রবল কৌতূহলের সাথে মানুষ মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে এর ভেতরে কি চলছে।

এবার এর ভেতরে প্রবেশ করা যাক। কিছু কমবয়সী মহিলা, প্রত্যেকের মাথায় রঙ্গিন স্কার্ফ জড়ানো, একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে শিশুদের রেলগাড়ি খেলবার মতো একজনের পিছে আরেকজন ঘরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে তারা থামছেন, নিজেদের দিকে তাকিয়ে আনন্দে হাসছেন এবং সবাই একসাথে হাততালি দিচ্ছেন। তারা একসাথে একটি গান গাইছেন, তারই ছন্দে সবাই ঘুরছেনঃ

“আরা ব্যগগুনে বাইবইন, আরা ব্যগগুনে দোস্তো, (আমরা সবাই ভাইবোন আমরা সবাই বন্ধু)।”

আপাদমস্তক উজ্জ্বল পোশাকে আবৃত এক নারীকর্মীর নেতৃত্বে এই বাঁশের ঘরে সবার স্বাধীন বিচরণ, যার নাম হামিদা আক্তার জাহান।

গোলাপী জামা পড়া একজন মেয়েকে তিনি সামনে ডাকেন। সে উঠে দাঁড়াতেই তাকে উৎসাহ দিতে আশেপাশের সবাই তাকে ঘীরে হাততালি দিতে শুরু করে।

মেয়েটি রাখাইন ভাষায় একটি ‘কাব্যিয়া’ (কবিতা) আবৃত্তি করা শুরু করে। অন্যরা সবাই তার সাথে গলা মেলালে কবিতাটি মুহূর্তেই যেন একটি গানে পরিণত হয়!

এই গানগুলো অস্থায়ী আবাসে বইয়ে দেয় শান্তির সুবাতাস। পুরো অস্থায়ী আবাস জুড়ে আমরা এরকম ১৯২টি কেন্দ্র পরিচালনা করছি, যার ফলে এই গানগুলো এলাকার সবার কাছেই এখন খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে উঠছে।

একজন পুরোদস্তর পেশাদার মনোসামাজিক পরামর্শদাতা হিসেবে হামিদার অস্থায়ী আবাসের মানুষগুলোর সাথে কাজ করার সময় নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার কথা। কিন্তু অক্টোবর মাস থেকে তিনি যখন এখানে এসে কাজ শুরু করলেন, প্রথম দিন থেকেই তীব্রভাবে অনুভব করলেন এখানে পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন এবং মাঝে মাঝে তিনি নিজের আবেগ বিসর্জন দিয়ে ওই মানুষগুলোর একজন হয়ে ওঠেন। কাজটা এতই কঠিন।

হামিদা প্রথম যেদিন অস্থায়ী আবাসের মানুষগুলোর মাঝে কাজ করতে আসেন, সেদিন তিনি দেখতে পান একজন অল্পবয়সী মা তার মাথায় খুবই ভারী একটি বস্তা নিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে অনেক কষ্ট করে হেঁটে চলেছেন। সেই বস্তায় ছিল বহুকষ্টে সংগ্রহ করা সহায়তা সামগ্রীগুলো। তখন দুপুরবেলা। বস্তাটা তার মাথার উপর ভীষণভাবে কাঁপছিল যেন সেটা যখন তখন পড়ে যাবে। কিন্তু তার পক্ষে হাত দিয়ে বস্তাটি ধরা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ দুই হাত দিয়ে তিনি দু’পাশে তার চার সন্তানের হাত ধরে হাঁটছিলেন। হামিদা আরও খেয়াল করলেন, দুপুরের ওই প্রখর রোদ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ছোট শিশুগুলোর কারও গায়ে সামান্য কাপড় পর্যন্ত নেই। উদাম পিঠে তারা হেঁটে চলেছে তাদের বিপন্ন মায়ের সাথে।

পরের দিন। তিনি আরও দুইটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন। একটি শিশু অনেক ভারী ওজনের একটি সহায়তা সামগ্রীর বস্তা বয়ে নিয়ে যাবার সময় ভার বইতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেদিনই তিনি আর একজন ছোট্ট মেয়েকে দেখলেন যে দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে, একা, পথ হারিয়ে পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত টিলা বেয়ে পথ হারিয়ে একবার উঠছিলো আবার নামছিলো।

হামিদা অনেক বছর ধরে একজন মনোসামাজিক পরামর্শদাতা হিসেবে কর্মরত আছেন, কিন্তু এরকম কোন দৃশ্য তিনি কখনই দেখেননি। অস্থায়ী আবাসগুলো পরিকল্পনাহীনভাবে, অনিরাপদভাবে মাইলের পর মাইল জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে যেখানে না আছে কোন রকম মানসিক শান্তি বোধ করার কোন পরিবেশ- বা জায়গাটিকে আপন ভেবে নেয়ার মত কিছু।

“শুরুতে এটা ছিল খুবই কঠিন একটি কাজ”, হামিদা শিশুবান্ধব কেন্দ্রে তার শুরুর দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন, “শিশুরা সবাই চুপচাপ বসে থাকত, কেউ কেউ তো কোন শব্দ পর্যন্ত করতো না। বাকি অনেকেই খালি উসখুস করতো বের হয়ে যাবে বলে।”

“প্রথমদিকে দেখা আরও একটি দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। একদিন আমি দেখলাম দুইজন শিশু, বয়স কয়েক মাস, গায়ে কোন কাপড় নেই, একটি ম্যাটের এক কোণায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাদের বড় ভাই আমাকে জানায় এছাড়া তাদের ঘুমানোর আর কোন জায়গা নেই।”

প্রতিটি শিশুকেই এখানে আসবার আগে মুখোমুখি হতে হয়েছে অবর্ণনীয় এবং অকল্পনীয় সব পরিস্থিতির।

তাদের ব্যক্তিগত অতীত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না, কিন্তু তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমরা বর্তমানে তাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দিচ্ছি।”

মনোসামাজিক পরামর্শদানে পরিস্থিতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পন্থায় কাজ করাটা খুবই জরুরি। এখানে নীরবতা বজায় রাখলে চলবে না, সর্বদা সবাই আওয়াজ করবে কথা বলবে। বন্ধ দরজার ভেতর একা একা কারও সাথে কথা বলা হয় না। যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সবাই হয়েছে সে ব্যাপারেও কথা বলা হয়না।

পরামর্শদাতাগণ কাজ করছেন ইতিবাচকতা এবং আনন্দ ছড়িয়ে দিতে, একটি দৃঢ় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলার লক্ষ্যে। কমবয়সী মহিলা এবং শিশু-কিশোররা একত্রে হাত ধরে কখনও গান করেন, কখনও নাচেন- আবার কখনও বা কেউ সবাইকে মজার কোন গল্প শোনান।

এখানে যা অবশ্যই উল্লেখ্য, তা হলো এই সমস্ত কিছু রাখাইন ভাষাতেই হয়ে থাকে।

“এখানে কেউ কোন বাংলা গান বা বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে না। কোন ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালী খেলাধূলাও এখানে হয়না। বরং, এখানে শিশুদের তাদের ইচ্ছামতো যা খুশি খেলতে উৎসাহ দেয়া হয়, যা ইচ্ছা গাইবার স্বাধীনতা দেয়া হয়। বেশিরভাগ সময়ই তারা ‘উঁচি বাঁচ’, ‘পয়সা খেলা’ আর ‘রশি ফাল’ খেলে থাকে। এগুলোই তাদের প্রিয়।”

কেন্দ্রের সঞ্চালকগণ প্রত্যেকেই যতটুকু সম্ভব শিশুদের খেলা, গল্প বলা এবং ছবি আঁকায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন।

শিশুরা নিজেদের মতো সাজে- যেমন কেউ রাজা, কেউ রাণী আবার কেউ বা অন্য কাউকে অভিনয় করে দেখায়, সবই তাদের ইচ্ছেমতন!

শিশুদের কিছু কিছু ব্যবহার এবং বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়ে থাকে, যেমন জেন্ডার বিভাজন এবং অন্যদের সাথে উগ্র ব্যবহার। প্রয়োজন অনুযায়ী কোন কোন শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়ে থাকে, মনোসামাজিক পরামর্শদাতাগণ তাদের যত্ন নেন সম্পূর্ণ আলাদা কোন পন্থায়।

শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলোতে সাধারণত একেকটি সেশন দুইজন পরামর্শদাতা দ্বারা সঞ্চালিত হয়ে থাকে- একজন থাকেন স্থানীয়, আরেকজন থাকেন মিয়ানমারের নাগরিক।

“এই পদ্ধতিতে ঘুচে যায় ভাষাগত দূরত্ব, আর শিশুরা এমনিতেই নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমরা ভিতর থেকে দেখতে পাই বাবা-মায়েরা বাইরে থেকে অনেক আগ্রহভরে দেখেন তাদের ছেলেমেয়েরা কি করছে। শিশুরা যখন গান গায় তখন তারা খুবই আনন্দ পান, আমরা বুঝতে পারি তখন তারা কিছু সময়ের জন্য যেন নিজেদের সংস্কৃতিকে খুঁজে পান।”

“শিশুরা খুবই উৎসাহী এবং সবকিছুতেই তারা সাড়া দেয়। একে অপরকে তারা সবসময় সাহায্য করে।”

শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলো সকাল ৮.৩০ থেকেই খুলে যায়। ছয় বছর বয়সের কমবয়সী শিশুরা সকাল ১১টা পর্যন্ত সেখানে থাকতে পারে। এরপর সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৬-১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরেরা সেখানে অবস্থান করে। দুপুর ২টা থেকে কেন্দ্রগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যেকোন বয়সের শিশু-কিশোর তখন সেখানে যেতে পারে ও পরামর্শদাতাগণ তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করে থাকেন।

কক্সবাজারের অস্থায়ী আবাসে গড়ে ওঠা প্রায় ২০০টি শিশুবান্ধব কেন্দ্র একই সাথে শিশু-কিশোর এবং মহিলাদের জন্য পরামর্শকেন্দ্র হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭৭,০০০ শিশুকিশোরকে মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে, এবং প্রায় ১,৫০০ নারী নিয়মিত এই কেন্দ্রগুলো থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে থাকেন।

এ পর্যন্ত ৬০০,০০০ এরও বেশি মানুষ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে কক্সবাজারে প্রবেশ করেছেন। এই মানুষগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মহিলা ও শিশু। তারা অধিকাংশই শিকার হয়েছেন যৌন এবং জেন্ডার-ভিত্তিক কোন নির্যাতনের।

“এটি খুবই স্পর্শকাতর একটি কাজ। আমাদের খুবই সতর্কভাবে তাদের কথা শুনতে হয়, তাদের আচার-আচরণ এবং ভাষার প্রতিও অত্যন্ত সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হয় এবং একই সাথে আমাদের বজার রাখতে হয় পরিপূর্ণ গোপনীয়তা। যাই ঘটুক না কেন, আমাদের একই সাথে এই মানুষগুলোর প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল এবং নিরেপক্ষভাবে তাদের সহায়তা প্রদান করতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

হামিদা কক্সবাজারের অস্থায়ী আবাসে একজন ফিল্ড কর্ডিনেটর হিসেবে এই মূহুর্তে কাজ করছেন। তিনি একই সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমার থেকে আগত মানুষদের সাথে অত্যন্ত নিবিঢ়ভাবে কাজ করার জন্য কর্মী নিয়োগ করছেন এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। তিনি কর্মীদের তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন, দ্বি-মাসিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত সকল কর্মকান্ড সম্পর্কেও থাকেন ওয়াকিবহাল।

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হামিদার মতো কর্মীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের কাজের প্রভাব সেখানকার মানুষদের মধ্যেও সূদুরপ্রসারী।

ছোট ছেলেমেয়েরা নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে এখানে এসেছে, নতুন করে সব ফিরে না পেলেও তারা পেয়েছে শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলোতে অন্তত একটি নিরাপদ এবং স্বাভাবিক পরিবেশ।

“আমরা চাই এখানে এসে শিশুরা আর কিছু না পাক, অন্তত একবার এই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে তাদের কাছে যেন জায়গাটি নিরাপদ এবং আপন মনে হয়। কেন্দ্রগুলোর বাইরে পরিবেশ কতটুকু অনিশ্চিত সেটা আমরা জানি, কিন্তু আমরা এটুকুই চাই এখানে যেন তারা প্রতিদিন আসে এবং নিজেদের স্বপ্নের মাঝে কেউ যেন রাজা, রাণী, সিংহমশাই হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে পারে। তারা এখানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করুক, খুশি থাকুক। এই নিরাপত্তাটুকুই তাদের সকল অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার সাহস জোগাবে।”

2 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments