গ্রামের একটি পরিবারের সার্বিক আয়ে পশুপালনের ভূমিকা অনেক সময়ই প্রত্যক্ষ করা যায় না। অনিশ্চিত আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিবেচনা করলে ধান বা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে তুলনায় পশুপালন বেশ সাশ্রয়ী ও নির্ঝঞ্জাট। উদাহরণস্বরূপ, ভেড়া বা ছাগল যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাই পশুপালনে মানুষের আগ্রহ দিনদিন বেড়েই চলেছে।
সিলেটের ধনকান্দি গ্রামের বাসিন্দা হাজেরা বেগম হন্তদন্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন আসতে একটু দেরি হবার জন্য। “কিছু মনে কইরেন না, একটা মিটিং ছিল তো!”
গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য হাজেরা, সেখানেই ছিল তার মিটিং। “আমি চাই সবাই মিটিংগুলোতে থাকুক। সবার কাজের কি অবস্থা, কার কি সুবিধা-অসুবিধা, এসব ব্যাপার নিয়মিত জানার জন্য আমরা মাসে অন্তত দুইবার মিটিং করি।”
দু’বছর আগেও, হাজেরার জীবনের একেকটি দিন ছিল অনেক কষ্টকর এবং শ্রমসাধ্য; তখন খুব কমই তিনি বাড়ির বাইরে বের হতেন। চার সন্তান, কৃষক ও খন্ডকালীন দিনমজুর স্বামীর জন্য রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করাই ছিল তার প্রধান কাজ। অতীতের এই কষ্টের কথাগুলো মনে পড়লে হাজেরা বেগমের আর খারাপ লাগে না; বরং তার হাসি পায়। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে তিনি সেই হাসি লুকানোর চেষ্টা করেন।
এখন তিনি আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত, কথাবার্তাতেও অনেক আত্মবিশ্বাসী। বিভিন্ন কাজে তাকে এখন অনেক সময় বাড়ির বাইরেও যেতে হয়। হাজেরা বেগম এবং তার ২১টি ভেড়া, গ্রামে এখন সুপরিচিত।
হাজেরার এই পরিবর্তন তার সন্তানদের চোখ দিয়ে দেখলে হয়ত আরো বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। তিন মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে বড়মেয়ে মাহমুদার বিয়ে হয়ে গেছে। মেজো মেয়ে জান্নাতুল, ৯ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ার পর তার পড়াশোনা থেমে যায়।
“আমি স্কুলে যেতে চাইতাম, কিন্তু পরিবারের অনেক কিছু আমাকে দেখভাল করতে হয়। আমার মা’র পক্ষে তো একা সবকিছু করা সম্ভব না।”
জান্নাতুলের ছোট দুই ভাইবোন সাবরিনা এবং সালেহ, দুজনেরই আছে পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ। সাবরিনা হাই স্কুলের ছাত্রী। সবার ছোট সালেহ- সে একটি স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা শেষ করেছে এবং পড়াশোনার পাশাপাশি সে কবিতা লিখতেও পছন্দ করে।
জান্নাতুল হাসতে হাসতে বলে, “আমার ভাইটা কবিতা লিখতে এবং উপন্যাস পড়তে ভালোবাসে। ভেড়া পালনের মাধ্যমে আমাদের পরিবারের আয় বাড়তে শুরু করলে সাবরিনা আর সালেহ’র স্কুলে যাওয়া শুরু হয়। শুরুতে আমাদের সাতটি ভেড়া ছিল, এখন আছে একুশটি। মা প্রশিক্ষণ নেয়াতে ভেড়াদের স্বাস্থ্যের খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি হতে থাকে।”
ভেড়া পালন হাজেরার পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। পশুপালনে সামান্য কিছু বিষয়ে নজর দিলে এখান থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হওয়া সম্ভব। হাজেরার একজন প্রতিবেশীর আছে ছোট একটি পুকুর, সেখানেও উৎসাহের সাথে চলছে মাছ চাষ। বিক্রী করবার মত পর্যাপ্ত না থাকলেও এতে পারিবারিক চাহিদা মিটছে। একই সাথে পুকুর থেকে কিছুটা দূরে ছোট একটা জায়গায় বেড়া দিয়ে চাষ হচ্ছে করল্লা।
এই ধরণের ক্ষুদ্র পরিসরের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো শুধু হাজেরাকেই নয়, তার গ্রামের আরও অনেককেই অনেকভাবে উপকৃত করেছে। হাজেরার মত কয়েকজন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়াতে পুরো গ্রামই এখন পশুপালন এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের কৃষি কর্মসূচিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে চলেছে।