হাঁসেদের মা

June 22, 2017

প্রতিদিন ধনকান্দি গ্রামে সূর্যাস্তের ঠিক আগের মুহূর্তে, আজকাল, অপূর্ব এক দৃশ্য চোখে পড়ে। গোধূলিতে যখন দিগন্তবিস্মৃত গমের ক্ষেত সবুজ রঙে ডুবে যায়, তখন কোত্থেকে যে হাজারও ক্ষুদ্র বিন্দু এসে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক বিশাল মিছিলে রূপ নেয়! কিছুক্ষণ পরেই স্পষ্ট হয়, এগুলো আর কিছু নয়, গ্রাম বাংলার চিরকালিন অনুষঙ্গ এক বিশাল হাঁসের পাল। উজ্জল নীল শাড়ি পরনে এক নারীর ইশারায় গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে এই মিছিল।

গ্রামের পথ দিয়ে চলছে বানুমতির হাঁস

যার যত্নে এই হাঁসগুলো বেড়ে উঠছে তিনি হলেন বানুমতি। নিজের খামারের চারশ হাঁস সারাদিন মাঠে চরিয়ে এখন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। ‘ওই ভয় দেখাইস না’- একটা ছোট ছেলে হাঁসগুলোর কাছাকাছি যেতেই বানুমতি ধমকে ওঠেন – ‘ভয় দেখাইলে ওরা ডিম পাড়া বন্ধ কইরা দিব, জানস না।’

হাঁসের ডিম বিক্রি করে বানুমতি এখন সপ্তাহে ১২,০০০ টাকার অধিক আয় করে

বানুমতির হাঁসগুলো দৈনিক অন্তত তিনশ ডিম পাড়ে। ডিম বিক্রি করে প্রতি সপ্তাহে তাঁর আয় হয় ১২,০০০ টাকারও বেশি!

বানুমতি স্থানীয় গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার সদস্য। সংস্থা থেকে ৯০,০০০ টাকা ঋণ নেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে এক হাঁসপালকের কাছ থেকে তিন মাস বয়সী চারশটি হাঁসের বাচ্চা কেনেন। সঠিকভাবে হাঁসপালন করতে পারলে আমাদের দেশে অনেক কম বিনিয়োগে যে বেশি লাভ করা সম্ভব, বানুমতি তার উদাহরণ।

রান্নাঘর এবং বাগানের উচ্ছিষ্ট, বীজ, শস্য, পোকা, ঘাস ইত্যাদি হাঁসের প্রধান খাদ্য। অতএব হাঁসপালনে খুব একটা খরচ হয় না। তুলনায় লাভ বেশি। হাঁসপালন বাংলাদেশের নিচু ও উপকূল এলাকায় বানুমতির মতো আরও অনেকের জন্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।

দুই সন্তানসহ বানুমতি

বানুমতির ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। আর বড়ছেলে তাঁকে খামারের কাজে সাহায্য করে। অনেক টাকা ধারদেনা করে বড়ছেলে কাজের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সব ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সে নানা কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে বানুমতির জায়গাজমি বিক্রি করতে হয়েছিল। ‘লাভের টাকা থেকে আমাদের এখনও দেনা শোধ করতে হয়, কিন্তু আমি জানি ভবিষ্যতে আমার আরও অনেক, অনেক কিছু করার সুযোগ আছে’ বলেন তিনি।

এই গ্রামের যে-সব পরিবারে উপার্জনক্ষম সদস্য আছে তাদের বেশির ভাগই এখন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে সক্ষম। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং সামাজিক সচেতনতামূলক ও আর্থিক নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এসব পরিবারের মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।

বছর দুয়েক আগেও গ্রামের মহিলারা আমাদের মাঠ কর্মীদের সঙ্গে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে কথা বলতেন। আর এখন তাঁরাই গ্রাম উন্নয়ন সংগঠনের বৈঠকে সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলেন।

একসাথে ঘরে ফিরছে হাঁসের দল

বানুমতির মতো তার গ্রামের আরও অনেক নারীই মায়ের মমতায় হাঁসপালন করছেন। একটু অদ্ভুত দেখতে হলেও প্রতি সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে দলবেধে হাঁসেদের এই ঘরে ফেরার মিছিল এখন আর তেমন অপরিচিত নয়। যাকে আরও অসাধারণ করে তোলে নানা রঙের শাড়িতে এই মিছিলগুলোর নেতৃত্ব থাকা একেকজন গর্বিত, আত্মবিশ্বাসী নারী।

উল্লেখ্য যে, শেভরনের সহায়তায় ব্র্যাক এবং আইডিয়া-র দ্বারা পরিচালিত জীবিকা প্রকল্পের সংস্পর্শে এসে হাঁসপালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন বানুমতি। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় গোষ্ঠীভিত্তিক গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা তৈরি করে এই প্রকল্পটি অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments