শাহানা মনে করেন চাকুরির শুরু থেকেই তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল মেয়েদের বাইরে কাজ করা নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। “সকলকে এটা বোঝানো ছিল এক অসম্ভব কঠিন ব্যাপার যে মেয়েদের বাইরে কাজ করাটা কোন খারাপ বিষয় নয়।”
শাহানা আখতার। মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতে কর্মরত আছেন চট্টগ্রামের কোতোয়ালি এলাকায়। ব্র্যাকের সাথে আছেন সাত বছর হলো।
নিজের লাল স্কুটারটার সাথেই শাহানার দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে। স্কুটারে ঘুরে ঘুরে তিনি ছোট দোকানগুলোতে যান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেন। ব্র্যাকে এই বছরগুলোতে শাহানা অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করেছেন। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে কিস্তিও আদায় করে চলেছেন।
শাহানা বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের চরলক্ষ্যা নামক গ্রামে। শহর থেকে আরও অনেক দূরে এক রক্ষণশীল গ্রাম। মেয়েকে নিয়ে শাহানা শহরের কোতোয়ালিতেই এখন থাকেন, কিন্তু সেই রক্ষণশীলতার বলয় ভেঙে বেরিয়ে শহরে আসাটা ছিল এক বিশাল সংগ্রাম। স্কুল শেষ হবার আগেই বিয়ে হয়ে যায় শাহানার, তবু তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন এবং পাশাপাশি কাজ করে সঞ্চয় করে যেতেও ভোলেননি।
শ্বশুরবাড়ি চেয়েছিল শাহানা ঘরে থেকেই সন্তান লালন করুক। পরিবারেই নিজেকে নিবেদন করুক পুরোপুরি শাহানা, এটি ছিল দাবি। এই দাবি না মেনে একসময় স্বামী সন্তানসহ তিনি আলাদা হয়ে যান এবং নিজেদের মত থাকতে শুরু করেন। “খুবই কঠিন একটা সময় ছিল সেটা, বিশেষ করে তখন থেকেই দুজন চাকরি করি।”
শাহানা মনে করেন চাকুরির শুরু থেকেই তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল মেয়েদের বাইরে কাজ করা নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। “সকলকে এটা বোঝানো ছিল এক অসম্ভব কঠিন ব্যাপার যে মেয়েদের বাইরে কাজ করাটা কোন খারাপ বিষয় নয়।”
ব্র্যাকে শাহানার প্রধান দায়িত্ব হলো এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে তাদের ঋণ দিয়ে সহায়তা করা। ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে এই ব্যবসায়ীদের কেউই পুরোপুরি জানেন না, শাহানা এবং তাঁর দল এই মানুষগুলোকেই সহজে ঋণ দিয়ে তাদের জীবনকে করেছেন অনেক সহজ।
কখনও কখনও এমন সময় আসে যে সদস্যরা সময়মত কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না, এমনকি অনেক খুঁজেও কারও সন্ধান মিলছে না অথচ কিস্তি বাকি রয়েছে এমনও হয়েছে। “আপনি মহিলা মানুষ, টাকা তুলতে আপনি দোকানে আসেন কেন?” এমন প্রশ্ন তো শাহানাকে অহরহ শুনতে হয়। শাহানার নিজের ধারনা হলো, একজন মহিলা নিজেই পাওনা টাকা তুলতে চলে এসেছেন তাতে বিব্রত হয়েই হয়ত অনেকে এই প্রশ্ন করে বসেন।
এসব কথা শাহানাকে তাঁর দায়িত্ব এবং কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। “কাজটা কখনই সহজ নয়। সহজ হবার কথাও না। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হলে আসলে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। কঠিন সব দায়িত্ব গ্রহন করার সামর্থ্য থাকতে হবে।” তাঁর ধারণা, সমাজে এমন মানুষ অনেক আছেন যারা নিজেদের আর্থিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে দেখভাল করতে জানেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এমন অনেকেই তাকে যতটুকু সম্মান দেন, সেই তুলনায় কিছু মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তাঁর কাছে কিছুই নয়। মানুষের এই সম্মানকে বুকে ধারণ করেই তিনি প্রতিদিন নতুন শক্তি নিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
“আমি কালেকশনে বের হলে লোকজন আমাকে দেখে বলে, ঐ যে স্কুটি আপা যাচ্ছে!” শাহানার মুখে এ কথা বলার সময় নির্মল আনন্দের এক হাসি লেগে থাকে। এক সময় যে মেয়েটিকে পদে পদে শ্বশুরবাড়িতে অপমানিত এবং হেনস্তা হতে হয়েছে তিনি আজ নিজ এলাকার সদস্যদের চোখে সম্মানের আসনে আসীন। যেসব সদস্য সময়মত কিস্তি পরিশোধ করেন না বা করতে পারেন না, তাদের অন্যান্য সদস্যরাই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে মনে করিয়ে দেন, “কিস্তি দিয়ে দাও, নয়ত স্কুটি আপা কিন্তু চলে আসবে!”