হারিয়ে যাওয়া জামদানির ঘরে ফেরা

July 11, 2021

জামদানি এক অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম; বাংলাদেশের অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ইউনেসকো ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জামদানিকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটি’র প্রতিনিধি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ২০১৬ সালে জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

একদা যে জামদানি ছিল আমাদের গর্ব, সময়ের বিবর্তনে সেই জামদানিশিল্প বিলুপ্ত হতে চলেছিল। জামদানির যে ডিজাইনগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিল, সেগুলোও আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই বিলুপ্তপ্রায় গৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। কীভাবে সম্ভব হল সেটা? কারা করল এই কাজটি?

অনেকেরই হয়ত জানা নেই, হারিয়ে যাওয়া এই জামদানিকে বাংলায় ফিরিয়ে আনার পেছনে আড়ংয়ের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কালের আবর্তনে বিলুপ্তপ্রায় জামদানিশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আড়ংয়ের উদ্যোগে ১৯৭৮-৭৯ সালে ঢাকার ডেমরা এলাকায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, বংশানুক্রমিকভাবে ডেমরা এলাকায় যেসব পরিবার জামদানি শাড়ি তৈরি করত, তারা যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় জামদানিশিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আড়ং সিদ্ধান্ত নিলো জামদানিশিল্পের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে ফজলে হাসান আবেদ কীভাবে জামদানির নকশাগুলো আবার উদ্ধার করা হল, তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই বর্ণনায় তিনি  বলেছিলেন, ‘ঢাকার পাশের ডেমরা এলাকায় তৈরি হয় জামদানি। ১৯৭৮-৭৯ সালে আমরা এই এলাকায় এ বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিলাম। তাতে দেখা গিয়েছিল, ডেমরা এলাকায় প্রায় সাতশ পরিবার এই জামদানি তৈরি করত। এই পরিবারগুলোর তৈরি করা জামদানি নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। মোগল সম্রাটের কন্যা যে জামদানি পরতেন, সেটি  নাকি একটা আংটির ভেতর প্রবেশ করানো যেত। জামদানি কাপড়ের অসাধারণ মসৃণতা বোঝানোর জন্যই হয়ত তৈরি হয়েছিল এই কিংবদন্তি। জামদানি বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের ঐতিহ্য। যুগের নতুনতর রুচির চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় ডেমরা এলাকার পরিবারগুলো জামদানি তৈরি বন্ধ করে দিচ্ছিল। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছিল। ভাবলাম, আমাদের এই ঐতিহ্যকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়?’

‘আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, গত দুশ বছর ধরে যত জামদানি তৈরি হয়েছে, সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। পৃথিবীর অনেক জাদুঘরে জামদানি সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ভারতের আহমেদাবাদ কালিকা জাদুঘরে আছে, কলকাতার আশুতোষ জাদুঘরে আছে। আমেরিকার শিকাগো জাদুঘরে আছে, আরও অনেক দেশের জাদুঘরেই আছে। ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। শুধু আমাদের জামদানি আমাদের সংগ্রহেই নেই। এখন এসব জামদানি কীভাবে সংগ্রহ করব? জাদুঘর থেকে তো আর নিয়ে আসা যাবে না। আমরা তখন বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে ঘুরে ঘুরে সব জামদানির ছবি তুলে স্লাইড করে নিয়ে এলাম। গত দুশ বছরে যতরকম জামদানি তৈরি হয়েছে, তার সবগুলো মোটিফ ব্যবহার করে আমরা তিনশ জামদানি শাড়ি তৈরি করলাম। ১৯৮১ সালে সেগুলো নিয়ে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে জামদানির প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হল।’

‘আমাদের আরেক গৌরবময় ঐতিহ্য নকশিকাঁথা। এই ঐতিহ্যটিও বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গিয়েছিল। কাঁথা বলতে আমরা বড় বড় সেলাইয়ের কাঁথা বুঝতাম। গত তিনশ বছর ধরে আমাদের দেশে যে নকশিকাঁথা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর মোটিফ এবং ফোঁড় হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা এগুলো অনুসন্ধান শুরু করলাম। এক পর্যায়ে গিয়ে দেখলাম, পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলো জামদানির মত আমাদের নকশিকাঁথাও সংরক্ষণ করে রেখেছে। ফোক মিউজিয়াম বোস্টন, মিউজিয়াম শিকাগো–এসব স্বনামধন্য জাদুঘরে রয়েছে আমাদের নকশিকাঁথা। আমরা নকশিকাঁথাগুলোরও ছবি তুলিয়ে নিয়ে এলাম। শিল্পীদের দিয়ে অসাধারণ সেই নকশাগুলো আবার আমরা আঁকিয়েছি। শিল্পীরা কাগজের উপর নকশাগুলো করে দিয়েছেন। সুরাইয়া নামের একজন শিল্পী প্রথমে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে  দু মাস কাজ করেছেন। সেগুলো মহিলাদের দিয়েছি। কাগজে করা নকশাগুলো তারা সুচের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কাঁথায়। এভাবে আমরা হারিয়ে যাওয়া মোটিফগুলো ফিরিয়ে এনেছি।’

জামদানির উৎকর্ষকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করার লক্ষ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালে আয়োজন করেছিল ‘ঐতিহ্যের বিনির্মাণ’ শিরোনামে একটি উৎসবের। সেই উৎসবে ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ উল্লেখ করেছিলেন,  ‘ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় আড়ং আজ দেশ ও বিদেশে এক সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত ও ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শ ও সহযোগিতা এই বিষয়ে পরোক্ষভাবে কাজ করছে। জামদানির মোটিফ ক্যাটালগ দুষ্প্রাপ্য; তবে জামদানি বয়ন নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ আড়ং ডিজাইন স্টুডিওর আর্কাইভে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত রয়েছে।’

আড়ং যদি সেই সময় জামদানি আর নকশিকাঁথা সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ না করত, তাহলে হয়ত আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই দুই শিল্প বিলুপ্ত হত। এ প্রসঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা ডিজাইনে যতরকম জামদানি এখন পাওয়া যায়, তা হয়ত পাওয়া যেত না। যে মোটিফগুলো আমরা উদ্ধার করেছি, এখন আর সেগুলোর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নকশিকাঁথার ব্যাপারেও সেই একই কথা। নকশিকাঁথা যে এখন শিল্পিত সামগ্রী হিসেবে বহু বাড়িতে স্থান করে নিয়েছে, তার পেছনে আড়ংয়ের অবদান অনেক।’

‘১৯৭৭ সালে আয়েশা আবেদসহ আমি একবার গিয়েছিলাম জামালপুরে। জামালপুরে তখন আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি চলছিল। সেখানে গিয়ে জানতে চাইলাম, এখানকবার মহিলারা কী ধরনের কাজ করতে পারেন? আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির  আওতায় মহিলাদের কর্মসংস্থান তৈরির কাজ জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাঁদেরকে কীভাবে কাজের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তা-ই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। একজন ব্র্যাককর্মী বললেন, এখানকার দু-একজন মহিলা কাঁথার কাজ খুব ভাল করেন। তাঁকে ঐ মহিলাদের কাজের নমুনা নিয়ে আসতে বললাম। তিনি এক মহিলার হাতে করা খুব সুন্দর ভরাট নকশার একটা কাঁথা নিয়ে এলেন। বুঝতে পারলাম, এই অঞ্চলে নকশিকাঁথার ঐতিহ্য ছিল। ঐ মহিলাকে প্রধান করে দশজনের একটা গ্রুপ তৈরি করে দিলাম। তিনি সবাইকে হাতের কাজ শেখালেন। নকশিকাঁথার আরও অনেক শিল্পী তৈরি হল। এখন জামালপুরে প্রায় এগারশ মহিলা কাঁথার কাজ করেন। তাঁদের খুব কমসংখ্যকই আগে থেকে কাঁথার কাজ জানতেন। তাঁদের সবাইকে কাজ শেখানো হয়েছে, প্রশিক্ষণ দিয়ে পারদর্শী করে তোলা হয়েছে। তাঁরা এখন একেকজন নকশিকাঁথার নিপুণ শিল্পী। একদা নকশিকাঁথার জন্য জামালপুর অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। সেই গৌরবময় ঐতিহ্য তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা পেয়ে জামালপুরের মহিলারা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে এনেছেন।’

‘শুধু জামদানি বা নকশিকাঁথা নয়, আবহমান বাংলার হারিয়ে যাওয়া আরও অনেক ঐতিহ্যই আমরা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছি। এজন্য অনেক অর্থ এবং শ্রম আমাদের ব্যয় হয়েছে।বাংলাদেশের বিভিন্ন নকশার আলপনার একটা ঐতিহ্য আছে। দেখলাম, এই আলপনার নকশাগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় আমরা আলপনার হারিয়ে যাওয়া ডিজাইনগুলো সংগ্রহের  উদ্যোগ নিলাম। দু-তিনজন সংগ্রাহক মিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা আলপনার প্রায় তিনশ ডিজাইন সংগ্রহ করলেন। বাংলাদেশে কতরকম কারুনকশা যে আছে তার অন্ত নেই। সন্দেশের উপর নানা ধরনের নকশা হয়। পিঠার উপরে নকশা হয়। এসব নকশার সবই আমরা সংগ্রহ করলাম। বিভিন্ন ধরনের ব্লকপ্রিন্টে আমরা নকশাগুলো নিয়ে এলাম। মোট কথা, তখন আমরা কারুপণ্যের এমন একটা কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছিলাম, সেখানে থাকবে বাংলাদশের সব ধরনের কারুপণ্যের সমাহার। কারুপণ্য তো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা যাবে না। আর আনার দরকারও নেই। কারুনকশার বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। অবিরাম প্রচেষ্টায় আমরা সেগুলোকেই সংগ্রহ করলাম। এগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের গবেষণা চলছে। কারুপণ্যের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য আড়ংয়ের ভেতরে প্রচুর কাজ হয়েছে। নিরন্তর এসব প্রয়াস চলছে, এ সম্পর্কে লোকজন হয়ত অতটা অবহিত নয়।’

হারানো জামদানিকে ঘরে ফিরিয়ে আনা, নকশিকাঁথা কিংবা আলপনার গৌরব পুনরুদ্ধার করাই শুধু নয়, বিলুপ্তপ্রায় এসব ঐতিহ্যকে  সমকালীন শিল্পধারায় প্রবাহিত করে দিয়েছে আড়ং। কারুশিল্পীদের সামনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে। নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করেছে ঐতিহ্যের মূল ধারায়। আড়ংয়ের ৪০ বছর পূর্তির উৎসবে বাংলার কারুশিল্প এবং আগামী দিনের তরুণদের নিয়ে তামারা হাসান আবেদ যথার্থ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সাথে দেশীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন আরও জোরালো হবে। আমরা চাই, বাংলাদেশের এই নতুন প্রজন্ম বৈশ্বিক অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার পাশাপাশি নিজেদের ঐতিহ্যের সাথেও ঘনিষ্ঠ হোক, জানুক নিজেদের শেকড়টাকেও। আমরা স্বপ্ন দেখি, দেশীয় ঐতিহ্য এবং বৈশ্বিক অগ্রগতি এই দুইয়ের সমন্বয়ে বেড়ে ওঠা তরুণরাই আগামী দিনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।’

4.3 11 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments