হাওরের
সুখ-দুঃখ

February 2, 2020

হাওর উপজেলাসমূহে দারিদ্র্যের হার ২৯%। অথচ এই হাওরে ধানচাষ ভালো হয়। পানি থাকলে এখানে চলে মাছের কারবার। আজকাল সবজিচাষও শুরু হয়েছে। মাছ বা ধানচাষ না হলে হাওরের মানুষের নিজ এলাকায় কাজ পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। প্রতি মৌসুমে অনেকেই কাজের খোঁজে শহরে চলে যান।

চাকরির সুবাদে বছর দেড়েক হলো নিয়মিত হাওরাঞ্চলে আসা-যাওয়া করছি। এখনও পিছিয়ে পড়া জনগণের তালিকায় হাওরবাসীর নাম উঠে আসে। স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা কিংবা আধুনিক জীবনযাপনের যেকোনো সুবিধা পেতে তাদের বেশ কষ্ট করতে হয়।

ব্র্যাক সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আইডিপি) যোগ দেওয়ার পর ২০১৮ সালে প্রথমবার মাঠ পরিদর্শনে যাই কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায়। সারাদিন হাওরের জলাভূমিতে ঘুরে বেলাশেষে আমরা ইটনা মৃগা অফিসের মিটিংয়ে যোগ দিই। মিটিংয়ে বসেও আমি হাওরের পানির ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জলে জেগে থাকা ছোট ছোট হাটিতে (গ্রাম কিংবা গ্রামের অংশ) আমরা কাজ করি। বছরের ছয় মাস এখানে পানি থাকে, বাকি ছয় মাস শুকনো। এই শুকনো মৌসুমে হাওরের পানি শুকিয়ে যায়। কাদামাটিতে চলাচল করা তখন বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবুও জল কিংবা কাদামাটি পেরিয়েই আমাদের কর্মীরা পৌঁছে যায় হাটির বাড়িতে বাড়িতে। তাদের সুখ-দুঃখের কথা কখনও আমরা শুনি বাউলের গানের কথায় আর প্রাণ মাতানো সুরে। বাউল শাহ আব্দুল করিমের এমনই একটি গান-

হারা-জিতা-ছুবের বেলা কার পানে কে চায়

পাছের মাঝি হাল ধরিয়ো ঈমানের বেঠায়

ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।

বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়

কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়

ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।

হাওরে শুকনো মৌসুমে চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য। বর্ষায় নৌকো ছাড়া উপায় নেই। স্কুলে পড়তে বা চিকিৎসা নিতে পাড়ি দিতে হয় দূরের পথ। এমনও পরিবার রয়েছে, বর্ষা মৌসুমে তারা হাটির মাটিতেই কেবল দুকদম হাঁটার সুযোগ পান, বাকিসব পানিতে থৈথৈ। যে পরিবারের নৌকা নেই, সেই পরিবারের বর্ষায় চলাচলে কতো বিঘ্নই না পোহাতে হয়। কেউ যদি শহরে যেতে চায়, তাকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়, করতে হয় নৌকার জন্য অপেক্ষা। মনে পড়ছে, একবার পিএম কামরুজ্জামান ভাই ও ইউডিসি শহীদ উল্লাহ ভাইকে নিয়ে আমরা ইটনার কাছাকাছি একটা হাটিতে গিয়েছিলাম। আমাদের নৌকা দেখে একজন ছুটে আসে। জরুরি কাজে তাকে ইটনা উপজেলায় যেতে হবে। সে আমাদের সাহায্য চায়। সেদিন তাকে নিয়ে আমরা রওনা হই। তার মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা অনেকদিন মনে থাকবে।

ভরা বর্ষার অন্য রূপও রয়েছে। পানির ওপরে পড়ে সাদা-কালো মেঘের ছায়া। কোনো কোনো মেঘে বৃষ্টির ভার। আবার কোনো কোনো মেঘ কাগজের মতো সাদা। এখানে যেন বর্ষা জুড়েই চলে মেঘ-বৃষ্টি আর রোদের খেলা। চলাচল তুলনামূলক সুবিধাজনক, তাই বউ-ঝিয়েরা নাওরে যাওয়ার জন্য এ সময়কেই বেছে নেয়।

হাওর উপজেলাসমূহে দারিদ্র্যের হার ২৯%। অথচ এই হাওরে ধানচাষ ভালো হয়। পানি থাকলে এখানে চলে মাছের কারবার। আজকাল সবজিচাষও শুরু হয়েছে। মাছ বা ধানচাষ না হলে হাওরের মানুষের নিজ এলাকায় কাজ পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। প্রতি মৌসুমে অনেকেই কাজের খোঁজে শহরে চলে যান।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ অনুযায়ী দেশের উত্তরের দিকে ছোট-বড় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। ব্র্যাকের সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি ২০১৩ সাল থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলা, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার হাওর এলাকায় কাজ করছে।

আমি যখন থেকে হাওরে আসা-যাওয়া করছি, তখন অনেককিছুই গোছানো অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। ৩৫০০টি গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন নিজ এলাকার উন্নয়নে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রায় দুই লাখ (১৯১,১১৭) পরিবার সেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। যেখানে ২০১৩ সালে আইডিপি কর্মএলাকার মাত্র ১০% মানুষ সরকার ও অন্যান্য উৎস থেকে সেবা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে,  সেখানে এখন ৭৫% মানুষ সেবা গ্রহণ করছে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বানিয়াচং উপজেলার একটি হাওর অফিস ভিজিটের স্মৃতি। সেদিন ইউডিসি মিজান ভাইয়ের সঙ্গে অফিসের বাইরে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম। বাজারের দোকানের শেডে দাঁড়াতেই একজন স্থানীয় মুরুব্বি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বললেন। ধন্যবাদ জানাতেই জানতে চাইলেন আমি ব্র্যাকে কাজ করি কি না? সায় জানাতেই নিজ থেকে বলতে শুরু করলেন এখন তারা কেমন আছেন। জানতে চাইলাম ব্র্যাকের কথা। বললেন, টয়লেটের অভাবে এই এলাকায় মলমূত্রের গন্ধে একসময় চলাফেরা করা কঠিন ছিল। এখন আর কোনো দুর্গন্ধ নেই। ব্র্যাক এখানে বাড়ি-বাড়িতে শুধু টয়লেটের ব্যবস্থাই করেনি, মানুষকে সচেতন করতেও কাজ করছে।

আইডিপি কর্মসূচির মডেল অনুযায়ী দুর্গম হাওরাঞ্চলের মানুষেরা এখন একজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেই নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। একবারের হোম ভিজিটেই ব্র্যাকের একজন পিও মাইক্রোফাইন্যান্স, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় দশটি সেবা সম্পর্কে তাদের তথ্য দিতে পারেন। অংশগ্রহণকারীগণ যদি এসকল সেবার বাইরে অন্য কোনো সেবা নিতে চান, স্থানীয় ব্র্যাক অফিস বা স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে একজন পিও সেই সুযোগও করতে পারেন। এতে অংশগ্রহণকারীদের সময় বাঁচে আবার সংগঠনেরও ব্যয় সাশ্রয় হয়।

এ বছর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে ব্র্যাক সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী একটি সমন্বিত মডেল অনুসরণ করে এই উপজেলায় কাজ চলবে। আমরা সমন্বিত সেবার এই মডেল সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চাই, যাতে সর্বনিম্ন সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া সম্ভব হয়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Konak Pramaik
Konak Pramaik
4 years ago

খুব ভালো লাগলো পড়ে ।
ভালো থাকুক হাওড় বাসি