স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে শরণার্থীদের আগমনের প্রভাব: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

June 20, 2021

স্থানীয় অতিদরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ২০১৮ সালে ইউপিজি প্রোগ্রাম শুরু হয়, ইতিমধ্যে ৬,৯৭৮ অতিদরিদ্র পরিবারকে দুই বছর মেয়াদি গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের আওতায় সহযোগিতা করা হয়েছে। উক্ত সদস্যরা নিজেদের দক্ষতার সাথে মিল রেখে গবাদি পশু পালন, কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের এন্টারপ্রাইজ গ্রহণ করেছেন।

পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তি যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও নিপীড়নের শিকার হয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন অনুসারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে নির্যাতিত হয়ে নিজের বাড়ি ও দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া ব্যক্তিরা শরণার্থী। সারা পৃথিবীতে এই শরণার্থীরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত  (Vulnerable) অবস্থায় আছে। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়েছে।

২০১৭ সালের ২৫শে আগস্টের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে, গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, ব্যাপক যৌন সহিংসতা চালায়। ফলে তাদের অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তারপরও বাংলাদেশ সব সময় বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার ১৯৭১ সাল থেকে এখনও বাংলাদেশ অনুসরণ করে চলেছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ ধারায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণ শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এ দেশের সরকার ও জনগণ শরণার্থী ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি অধিক সমব্যথী এবং সব সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মিয়ানমারের ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে কয়েক দফায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সর্বশেষ তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ২০১৭ সালে। এর আগে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মিয়ানমারে ফেরত গেলেও ২০১৭ সালে এদেশে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কাউকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি।

মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা উন্নয়নশীল এবং ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গাদের বিপুলসংখ্যক উপস্থিতিতে এ অঞ্চলের স্থানীয় লোকজন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন?

রোহিঙ্গারা কৃষিজমিতে আশ্রয় নেবার কারণে কৃষিকাজ বন্ধ রয়েছে অনেকের। অর্থের অভাবে স্থানীয় শ্রমবাজার সস্তায় কাজ করছেন রোহিঙ্গারা। যার ফলে স্থানীয় শ্রমবাজারে স্থানীয়দের কাজ আগের মতো জুটছে না।

টেকনাফে আগে থেকেই বিশুদ্ধ পানির সংকট ছিল। বাড়তি লোকের চাপে সেই পানিতে এখন আরও টানাটানি পড়ছে। টিউবওয়েলের অতিরিক্ত ব্যবহারে অনেকগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম নানা সমস্যায় স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততা বিরাজ করছে।

এছাড়াও দেখা দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধি, কাজের সংকট ইত্যাদি। এমতাবস্থায়, স্থানীয় অতিদরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ২০১৮ সালে ইউপিজি প্রোগ্রাম শুরু হয়, ইতিমধ্যে ৬,৯৭৮ অতিদরিদ্র পরিবারকে দুই বছর মেয়াদি গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের আওতায় সহযোগিতা করা হয়েছে। উক্ত সদস্যরা নিজেদের দক্ষতার সাথে মিল রেখে গবাদি পশু পালন, কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের এন্টারপ্রাইজ গ্রহণ করেছেন। কক্সবাজারের মাননীয় জেলা প্রশাসক ২০১৮ সালে অতিদরিদ্র মানুষের মাঝে এন্টারপ্রাইজভিত্তিক সম্পদ হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।

সমস্যা সমাধানে ব্র্যাক এগিয়ে এসেছে তার গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ ধারণাটি নিয়ে। ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচের ৪টি মূলস্তম্ভ রয়েছে: জীবিকার উন্নয়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন। এই প্রোগ্রামের সদস্যদের সম্পদ হস্তান্তরের পাশাপাশি সুদমুক্ত ঋণ, জীবনদক্ষতা ও কারিগরি দক্ষতার প্রশিক্ষণ, এন্টারপ্রাইজের উন্নয়ন, আচরণগত পরিবর্তন, সঞ্চয় এবং আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।

বহু নৃগোষ্ঠী ও জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার চাকমা আদিবাসীর অনেকে অভাব–অনটনে দিন কাটায়। তাদেরই একজন মালো চাকমা (৪৫), টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের চাকমা পাড়ায় বসবাস করেন, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামী নিয়েই তার পরিবার।

পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে তিনি স্কুলে যেতে পারেননি। ১৫ বছর বয়সে, তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামী দিনমজুর। নতুন পরিবারের সাথে বেঁচে থাকার জন্য মালো চাকমা একই ধরনের লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন কারণ তার স্বামীর আয় খুব কম ছিল, যদিও তার পরিবার তার শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে কোনো সমর্থন পায়নি। এই পরিস্থিতিতে স্বামীর অসুস্থতার কারণে তিনি প্রতিবেশীদের বাড়িতে সহায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এতে সংসারে কিছু আয়-রোজগার হতো। তাদের বসবাসকৃত এলাকায় রোহিঙ্গাদের আগমনের পরে, দিনমজুর হিসেবে কম মূল্যে কাজ করায় তাদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এপ্রিল ২০১৮-তে, ব্র্যাক আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের অংশগ্রহণকারী নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং তিনি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, “ব্র্যাক এবং ইউএনএইচসিআর আমাকে অনুদান হিসেবে শুটকি মাছের ব্যাবসা শুরু করার জন্য ১০০০০ টাকা এবং একটি ছাগল (৪০০০ টাকা মূল্যের) দেয়। সেইসাথে ইনপুট সহযোগিতাও করা হয়েছে।” ব্যবসায়ের লভ্যাংশ দিয়ে তিনি শুটকি মাছের ব্যাবসার পাশাপাশি সুপারির ব্যাবসা ও পানের বরজ শুরু করেন।

“কোভিড-১৯ এর কারণে পানের সঠিক বাজারমূল্য পাইনি। লকডাউনের মধ্যে পর্যাপ্ত পাইকারী ক্রেতা পাওয়া যেত না। তবে পানের উৎপাদন ভালো ছিল তখন শামলাপুর বাজারে কিছুটা কম মূল্যে বিক্রি করেছি এবং আমরা আমাদের নতুন বাড়ি তৈরির জন্য সঞ্চয় করেছি। আশা করি এই বছরের মধ্যেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।”

২০১৮ সাল থেকে অনেক পরিশ্রম করে মালো চাকমা তার সম্পদ বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি বর্তমানে পানের বরজের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০,০০০ টাকারও বেশি আয় করেছি। শুটকি মাছের ব্যাবসা, শাকসবজি বাগান, মুরগি পালন, ছাগল পালন থেকে আমি যে লাভ করেছি তা দিয়ে এখন আমার কাছে দুটি পানের বরজ, তিনটি ছাগল, ২৫টি মুরগি, এবং কৃষি চাষাবাদের জন্য লিজ জমি রয়েছে। এখন মালোর বাচ্চারা বাসা থেকে পড়ালেখা করছে এবং তার পরিবারের নিরাপদ স্যানিটেশন এবং জলের ব্যবস্থা রয়েছে। মালো এবং তার স্বামী পরিকল্পনা করেছেন এই বছরের মধ্যে একটি নতুন বাড়ি করার জন্য, তাই তারা স্বপ্নের ঘরটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে।

এখন তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং সমাজে সম্মানিত। তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন, তিনি সবসময় স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য স্বাস্থ্যকর অনুশীলন বজায় রাখেন। এছাড়াও, ভিএসএসসি সদস্য এবং স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। তারা যেকোনো  প্রয়োজনে সর্বদা তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে।

আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম স্থানীয় ও বাস্তুচ্যূত মায়ানমারের নাগরিকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার জন্য কক্সবাজারের চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী পরিবারগুলোর জন্য সহায়তা সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। এটি তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনগুলোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতা, প্রশিক্ষণ এবং পরিকল্পনার সহায়তা প্রদান করে যা সুরক্ষিত এবং টেকসই জীবন গড়ে তোলার মাধ্যমে যেন চরম দারিদ্র্যের বাইরে চলে আসতে পারে।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Dr. Mokhleshur
Dr. Mokhleshur
2 years ago

Well said