সুরঙ্গের ওপারে আশার আলো

June 4, 2018

পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি শত শত বছরেও মাটির সঙ্গে মেশে না। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে। এতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

আহ্, আগামীকাল থেকে ছুটি! ঢাকা শহরের ব্যস্ত জীবন, কোলাহল, হৈ-হুল্লোড় ছেড়ে কদিনের জন্য চলে যাব নির্জন সাগরতীরে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতের বাসে টিকেট কেটে রওনা হলাম। সকালে চোখ মেলেই দেখি সামনে সমুদ্র। বাস তখনও গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ছুটে চলছে। আশা করছি, আর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই আমাদের যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে। দূরে ঢেউয়ের তালে চলতে থাকা সাম্পানগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন হাওয়ায় ভাসছে। রাস্তাটি কিছুদূর গিয়ে ডানে মোড় নিল। চোখের আড়ালে চলে গেল সমুদ্র। আমরা আমাদের গন্তব্যে চলে এলাম। আগে থেকে হোটেল বুকিং করা ছিল। কাজেই ঝামেলা নেই। হোটেলে ব্যাগ রেখেই চলে গেলাম সৈকতে। আমার মতো আরও অনেক পর্যটক এসেছেন। কেউ এসেছেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে, কেউ সপরিবারে। সবাই আনন্দ-উল্লাস করছে। খুব ভালো লাগছে।

এটাই বাস্তব

আনন্দের প্রথম অনুভূতিটা কাটিয়ে ওঠার পর কিছু অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। সৈকতে যাওয়ার প্রধান সড়কটি পেরিয়ে সামনের বালুচরে পা দিয়েছি আর অমনি চোখে পড়ল বালুর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা। ডাবের খোসা, বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট, বিস্কুট-চানাচুরের প্যাকেট, পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের পানির বোতল আরও কত কী! ভিজে বালিতে ছোটো ছোটো কাঁকড়ার হেঁটে চলার রেখার বদলে আমি এ কী দেখছি?

বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ বেড়াতে আসে। তাদের কাছে সৈকতের ময়লা-আবর্জনা অবশ্যই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে পর্যটকরাই শুধু প্লাস্টিক বা পলিথিন ফেলে সাগরপাড়ের এই পরিবেশকে দূষিত করে তা কিন্তু নয়। এটি বাড়ি থেকেও শুরু হতে পারে। মনে করুন, আপনি দোকান থেকে সদাই কিনে পলিথিন ব্যাগে ভরে নিয়ে এলেন। এরপর সেই পলিথিন ব্যাগটি ফেলে দিলেন। সেই ব্যাগ আবর্জনা হিসেবে বাতাস, বৃষ্টির পানির স্রোতে, বন্যা ইত্যাদির মাধ্যমে নানা জায়গায় স্থানান্তরিত হতে থাকে। আপনি জানেন কি, রাজধানী ঢাকায় যদি একটি পরিবার গড়ে ৪টি ব্যাগ প্রতিদিন ব্যবহার করে তাহলে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কোটি কোটি পলিথিন জমা হচ্ছে আমাদের ভূপৃষ্ঠে। পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি শত শত বছরেও মাটির সঙ্গে মেশে না। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে। এতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে তাতে বাষুদূষণ ঘটে।

হালকা ওজন, দামে সস্তা আর কী চাই! দরকারে-অদরকারে পলিথিন ব্যাগের বহুমুখী ব্যবহার তাই দিন দিন বেড়েই চলছে। উৎপাদনের শুরু অর্থাৎ ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে, যা কিনা এক বিলিয়ন হাতির ওজনের সমান! এক সমীক্ষা অনুসারে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টন।

সাগরের কান্না

এখন অবশ্য সৈকতে ময়লা ফেলার জন্য ঝুড়ি থাকে। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রায়ই সাগরতীরের বালুরাশিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায়। কিন্তু তাতে কি দৃশ্যপটের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়? আসলে আমরা ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ বা সামগ্রী যেখানেই ফেলি না কেন এগুলোর বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত নদীনালা, খালবিল বা সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। প্লাস্টিক ও পলিথিনজাত পণ্যের দূষণের চাপে সাগরের জল আজ ভারাক্রান্ত। পলিথিনজাত ও প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহার করে তা যেখানে-সেখানে ফেলে দিয়ে পরিবেশ নষ্ট করছি আমরা নিজেরাই। একটি তথ্য জেনে হয়তো অবাক হবেন, প্রতিবছর ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে সাগর-মহাসাগরে অবস্থানকারী মাছের যে ওজন, তার চাইতে বেশি থাকবে প্লাস্টিক বর্জ্য।

প্রাণীরা যখন প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে ফেলে

নদীনালা, খালবিল তো বটেই এমনকি মহাসাগরে বিচরণকারী বিভিন্ন পাখি ও জলজ প্রাণীর পেট পরীক্ষা করলেও প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যায়। জলজ প্রাণী ও পাখিরা অনেক সময় না বুঝেই প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে ফেলে। স্বভাবতই তারা এগুলো হজম করতে পারে না। ফলে তাদের খিদেও পায় না, খাবারও খায় না। এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে করুণভাবে তাদের মৃত্যু হয়। এর ফলে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে।

দূষণ রোধে

প্রতি মিনিটে বিশ্ববাসী ১০ লাখ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে। এই বিপুল পরিমাণ ব্যাগ ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হচ্ছে যা পরিবেশে কয়েক শ বছর অবিকৃত অবস্থায় বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে। আর সেইসঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার দিন দিন বাড়তেই থাকবে। তাহলে এই দুর্যোগের শেষ কোথায়? এই দূষণ রোধের জন্য প্রথমেই দরকার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সম্প্রতি পাট থেকে এক ধরনের পলিথিনের ব্যাগ তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের একদল গবেষক পাটের সেলুলোজ থেকে পলিথিন ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. মোবারক আহমদ খান। তিনি বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মহাপরিচালক।

সুরঙ্গের ওপারে সোনালি আশা

পৃথিবীতে প্রকৃতিতে মিশে যাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন যত পলিমার আছে তার বেশিরভাগই খাবারজাতীয় বস্তু (যেমন, ভুট্টা, ক্যাসাভা ইত্যাদি) থেকে তৈরি হয়। বাংলাদেশই প্রথম পাট থেকে তৈরি সেলুলোজকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ও চাপে বিক্রিয়া ঘটিয়ে পলিথিন তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে। এই ব্যাগ ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতি হয় না। এটি পানিতে থাকলে আস্তে আস্তে মিশে যেতে শুরু করে, পোড়ালে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়াও এটি অন্য পলিব্যাগের চাইতে দেড় গুণ বেশি ভারী পণ্য বহন করতে সক্ষম। সবচেয়ে বড় কথা মাটিতে ফেলে রাখলে মাত্র ২-৩ মাসের মধ্যে এটি সেখানে মিশে যায়। সেই সঙ্গে এটি পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলসে পরীক্ষামূলক এক সরকারি প্রকল্পের অধীনে এই ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এই ব্যাগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোনালি ব্যাগ’।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে মানুষের অসচেতনতার কারণে এখনও তা বন্ধ হয়নি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ যখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন পাট থেকে তৈরি আমাদের সোনালি ব্যাগ কিছুটা হলেও আশা জাগিয়ে তুলছে।

ছবিঃ প্রথম আলো, ডেইলি সান

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments