একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ লড়াই

April 26, 2020

কখনও ভাবিনি আমাদের দেশে করোনার মতো মহামারি দেখতে হবে। এমন দুর্দিনে আমার মতো সাধারণ একজন হয়েও আশেপাশের এত মানুষের সেবা দিতে পারব, তাদের সচেতন করে তোলার সুযোগ পাব- এ ছিল চিন্তারও অতীত।

আমি গ্রামে বড়ো হয়েছি, গ্রামেই থাকি, কাজও করি গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে, তাদেরই জন্য। আমার অভিজ্ঞতা বলে, কাগজে লেখা কোনো কিছু দেখলেই গ্রামের অনেকে, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ ধরে নেন এটা বোধহয় তাদের জন্য নয়, শহরের লেখাপড়া জানা, উচ্চবিত্ত মানুষদের জন্য এসব লেখা হয়েছে।

আমি শিখা রানী পাল। ২০১৩ সালে ব্র্যাকে স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করি। আমার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায়। আমার স্বামী একটি কাঠের স-মিলের দিনমজুর।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে অফিসে এ নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রথম এ সম্পর্কে আমি জানতে পারি। করোনাভাইরাস ও তার প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী সেই বিষয়গুলো সেদিন বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা হয়। আমি নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করতে থাকি। কারণ আমি বুঝতে পারি, আমরা সকলে মিলে এক ভয়ংকর যুদ্ধে নামতে যাচ্ছি। করোনা বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন পাওয়ার পর থেকে আমার এলাকার জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

প্রথম যখন এলাকায় কাজ করতে যাই, মানুষকে করোনা কী তা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সাধারণ সর্দি-জ্বর তো হতেই পারে, এ নিয়ে এত ভাববার কী আছে? এত নিয়ম মেনে চলতেই-বা হবে কেন?-এমন অসংখ্য প্রশ্ন ছিল তাদের মনে। গ্রামের পরিবারগুলোর হাতে খুব অল্প সময়েই পৌঁছে গেল ব্র্যাকের লিফলেট, কিন্তু তারপরও তারা যেন করোনাভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগের ভয়াবহতা বুঝতে পারছিলেন না। তারা বুঝতে পারছিলেন না দেখে আমি ছবি ধরে ধরে তাদের বুঝিয়ে বলেছি। তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি।

মানুষের সেবা দেওয়া আমার দায়িত্ব, আমার ব্রত। করোনার এই দিনগুলোতে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই কাজটিই করে যাচ্ছি। অনেক পরিবার আমার তথ্যের ওপর নির্ভর করেন, আমার কথায় আস্থা রেখে সে অনুযায়ী কাজ করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলতে আমি মোটেই ভয় পাই না। কারণ আমি জানি আমি সুরক্ষিত। আমার হাতে থাকে গ্লাভস আর মুখে থাকে মাস্ক। পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বাড়ি যাওয়ার কারণে আমার পক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহজ। তাছাড়া এখন তো কাউকে হাত দিয়ে স্পর্শ করি না। তবুও আমি চোখে দেখে দেখে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

নিরাপদ থাকতে কী করণীয় তা সবাইকে বুঝিয়ে বলি। সুযোগ পেলে নতুন কিছু নিজেও জানার চেষ্টা করি। মহামারি চলাকালীন বা অন্য যেকোনো স্বাভাবিক সময়, একজন মায়ের ও নবজাতক শিশুর বা অসুস্থ মানুষের সবসময়ই সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। একজন স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে সেই অধিকার রক্ষায় সাহায্য করা আমার কর্তব্য।

আমার এলাকার জনগণ সবাই কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করছে কি না- আমি তা এখন নিয়ম করে ফলোআপ করছি। সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের অনুরোধ করছি। যে বাড়ির লোক এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে মেনে চলছে না, সে বাড়িতে আবারও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। আমি সবাইকে বলি যে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন হলে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো মেনে চললে আমরা সবাই ভালো থাকব।

আমি মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একজন সম্মুখযোদ্ধা, আমি মানবতার পক্ষে লড়ছি। আমার জীবনযাপন খুবই সাধারণ, কিন্তু আমি মনেকরি বিপদে মানুষের পাশে থাকা, দুর্যোগে তাদের সচেতন করা একটি অসাধারণ কাজ। আমার পরিবারের জন্য যেমন আমার দায়িত্ব আছে, তেমনি আমার গ্রাম, আমার এলাকার মানুষও তো আমার পরিবার- তাদের পাশে তো অবশ্যই আমার থাকতে হবে। ব্র্যাকের সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি (আইডিপি)-এর স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে আমি কাজটি করতে পারছি।

 

লেখক রনজিৎ কুমার বৈষ্ণব, সেক্টর স্পেশালিষ্ট হিসেবে ব্র্যাকে কর্মরত আছেন। শিখা রানী পাল তার একজন সহকর্মী।

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত ও তাজনীন সুলতানা

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments