ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির উদ্যোগে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে ২০১২ সালে শুরু হয় রেডিও পল্লীকণ্ঠের সম্প্রচার। সে সময় থেকেই শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্থানীয় ও সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে এই কমিউনিটি রেডিও কাজ করে যাচ্ছে।
হ্যালো শ্রোতাবৃন্দ !
শুভ সকাল ! রেডিও পল্লীকণ্ঠ ৯৯.২ এফএম মৌলভীবাজার থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি!
সকাল ৯টায় রেডিও পল্লীকণ্ঠের সম্প্রচারের শুরুতেই থাকে সংবাদ পাঠ। আঞ্চলিক ভাষায় সম্প্রচারিত ১০ মিনিটের সংবাদ পাঠে উঠে আসে মৌলভীবাজারের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। সেইসঙ্গে থাকে বাজারদরের টুকিটাকি। সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় সংবাদপাঠের পাশাপাশি সংবাদ শিরোনামও নিয়মিত সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ২৫০ ওয়াটের ট্রান্সমিটার যুক্ত হয়েছে। ফলে মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জ এই ৩টি জেলার ১১ টি উপজেলার শ্রোতারা শুনতে পারবে। সপ্তাহের ৭ দিন, প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে চলে রেডিও পল্লীকণ্ঠ।
দিন গড়িয়ে বিকেল, শুরু হয় আড্ডা। চলতে থাকে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আলোর ভুবন’, তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘ইউনিয়নের কথা’, কিশোর-কিশোরীদের অনুষ্ঠান ‘সোনালি কৈশোর’ ইত্যাদি। সন্ধ্যার পর কোনোদিন শ্রোতারা শোনে বাউল গানের আসর ‘আরশিনগর’ অথবা হাওড় পাড়ের নবীন শিল্পীদের গাওয়া গান ‘কখনও বসন্ত কখনও শ্রাবণ’। এছাড়াও আছে নানা গানের অনুষ্ঠান, কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও ছায়াছবির গান, বাউল গান-আরও কত কী! অনুষ্ঠানের নামগুলোও বেশ সুন্দর! বাঁধনহারা, পূর্ব দিগন্তে, ছবিসুর, ভাটির টানে, সোনাবন্ধে, পরশমণি, ওগো বন্ধু পাশে থেকো ইত্যাদি।
কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সোনাফলা মাটি’ শুনে জেনে নেওয়া যায় চাষাবাদের বিভিন্ন নিয়মকানুন। এছাড়া রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘আমরার উন্দাল হরিজন ও নৃগোষ্ঠীবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘জীবন ধারা’ বেশ জনপ্রিয়। শিশুদের জন্য স্টুডিও থেকে সরাসরি চলে সঙ্গীত শিক্ষার আসর-‘মিষ্টি ময়না’। আরও আছে ইংরেজি শিক্ষার অনুষ্ঠান ‘চল খেলতে খেলতে শিখি’। রেডিও পল্লীকণ্ঠের প্রায় ৭০০-এর অধিক শ্রোতা ক্লাব আছে। এই ক্লাবের শিশুরা কখনও স্টুডিওতে, কখনও বিশেষ স্থানে একত্রে বসে নানা ধরনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে।
ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির উদ্যোগে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে ২০১২ সালে শুরু হয় রেডিও পল্লীকণ্ঠের সম্প্রচার। সেসময় থেকেই শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্থানীয় ও সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্র হিসেবে এই কমিউনিটি রেডিও নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই ব্র্যাকের রেডিও পল্লীকণ্ঠ জিতে নিয়েছে ২০ টির বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে ইউনিসেফ মিনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, এশিয়া প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন অ্যাওয়ার্ড, ফ্যামিলি প্ল্যাানিং মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ এ রেডিও পল্লীকণ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে , যা টানা সপ্তমবারের মত পল্লীকণ্ঠকে ভূষিত করেছে ।
তারুণ্যের কন্ঠস্বর রেডিও পল্লীকণ্ঠের এত বেশি পুরস্কার পাবার গোপন রহস্য কী? জিজ্ঞেস করলাম স্টেশন প্রোডিউসার আল আমিনকে। এই প্রোডিউসার হাসিমুখে বললেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই খুব সোজা একটা নিয়ম মেনে আসছি, আমরা গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলব, আমরা বলব তাদের মনের কথা। আর আমাদের দলের সবাই এই অঞ্চলের সন্তান, হাওড়ের জলে-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি। এখানকার মানুষের মনের কথা, জানতে চাওয়া, প্রয়োজন-সবই খুব সহজে বুঝতে পারি আমরা। কীভাবে তাদের প্রয়োজনে আমরা সাড়া দিতে পারব।’
আসলেই তাই! এই টিমের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় আপনি দেখবেন কী দুর্দান্ত আলো তাদের চোখেমুখে! প্রত্যেকের ভান্ডারেই রয়েছে গর্ব করার মতো অসংখ্য গল্প।
গল্পগুলোর একটু বিবরণ দিই-ঋতু আক্তারকে দিয়ে শুরু করা যাক। ইতিহাসের ছাত্রী তিনি, স্থানীয় কলেজে পড়ান। পাশাপাশি উপস্থাপনা করেন পল্লীকণ্ঠের সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে। তার অনুষ্ঠানে উঠে আসে রবি ঠাকুর-কাজী নজরুল ইসলাম-জসীমউদ্দীন-মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাদ যান না শেলি-শেক্সপিয়ার- সমরেশ। কথা বলেন অবসাদ, মানসিক স্বাস্থ্য,বা মাদকাসক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে।
এই ঘটনাটি না বললেই নয়-বাজারে দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা চা খেতে গেলে কেউ ভালো চোখে দেখত না। তাদের নানা কথা শুনতে হতো। পল্লীকণ্ঠে কর্মরত ওমর ফারুক মুন্না এই বৈষম্যের দিকটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরেন। এখন অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বাজারে গেলে তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকানো একটু হলেও কমেছে। এভাবেই কমিউনিটি রেডিও তার কমিউনিটির জন্য কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপায়ে।
দুলাল রায়ের গল্পটি বেশ মজার। একদিন রিকশা করে আসছিলেন রেডিও স্টেশনে। রিকশাচালক তার কাছে ভাড়া নয়, রেডিওতে বাঁশি বাজানোর জন্য ১০ মিনিটের সুযোগ চাইলেন। আত্মবিশ্বাসী রিকশাচালককে সেদিন ভাড়ার দেয়ার সঙ্গে বাঁশি বাজানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন তিনি পল্লীকণ্ঠের জনপ্রিয় বংশীবাদক। এভাবে পল্লীকণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে স্থানীয় শিল্পীদের।
পল্লীকণ্ঠের ঝুলিতে আছে এমনই অসংখ্য গল্প-সাহসিকতার গল্প, সংগ্রামের গল্প, হার-না-মানার গল্প। গ্রামের মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে তাদের উন্নয়নে কাজ অব্যাহত রাখুক রেডিও পল্লীকণ্ঠ। শ্রোতাবৃন্দ, শুনতে থাকুন রেডিও পল্লীকণ্ঠ।
আরও বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন পল্লীকণ্ঠের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব পেজে
অসাধারণ, শুভ কামনা রইলো