রঙিন উঠোনের খেলাঘর

December 2, 2021

শিশুদের ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ঘরটি আকর্ষণীয় করার জন্য রং ও নকশা করা এবং চলমান করোনা মহামারির জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন নিয়ে দশ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত টঙ্গীতে ১১ জন ও গাজীপুরে ৬ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

দুপুরের শান্ত রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে ছোট্ট গলিপথ পেরিয়ে বস্তিবাড়িটির উঠোন। উঠোনের চারপাশে টিন ও বাঁশের বেড়ার ঘর। দু’য়েকটি ইটের ঘরও আছে। উঠোনে ঢুকতেই বাঁশের তৈরি একটা কাঠামো, তাতে রংবেরঙের নকশা করা। উল্টোদিকের একটা পাকা ঘরে  কয়েকজন ছোটো ছেলেমেয়ে বসে খেলছে। আমাদের দেখে ঘরটির মালিক সখিনা বেগম এগিয়ে এলেন। সাদরে নিয়ে ঘরে বসালেন। দেখলাম এই ঘরটিও বাইরের বাঁশের কাঠামোর মতো রঙে-নকশায় ভরা। মাটিতে পাতা বিছানার ওপর কাপড়ের কয়েকটি পুতুল। মেঝেয় হাতের ছাপের নকশা।

এসেছি টঙ্গীর গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকার শিল্পপল্লীতে। বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেল, তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে অনেক তৈরি পোশাকের কারখানা। তারই ফাঁকে ফাঁকে শ্রমিক কলোনি। আশেপাশের কারখানায় কাজ করেন এমন অনেক নারী শ্রমিক তাদের সন্তানদের রাখেন এসব কলোনির মায়েদের কাছে যারা চাকরি করেন না। এ থেকে একদিকে তাদের উপার্জন হয়, অন্যদিকে শ্রমিক মা-বাবা নিশ্চিন্তে কারখানায় কাজ করতে পারেন। অন্যের সন্তান দেখভাল করা মায়েদের একজন সখিনা বেগম।

খেলাঘরটিতে বসে সখিনার কথা শুনি। বয়স পঞ্চাশের এদিক-সেদিক। দেশের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল। দরিদ্র ঠেলাচালক বাবা পুরো পরিবারকে ঢাকার নতুনবাজারে নিয়ে আসেন। তখন তার বয়স প্রায় ষোলো। কিছুদিন পর বিয়ে হয়ে চলে যান রিকশাচালক স্বামীর সংসারে। সেখানে উপার্জনের একটা উপায় চলে আসে হঠাৎ করেই। প্রতিবেশী এক নারী শ্রমিক তার শিশু সন্তানকে রাখতে অনুরোধ করেন। এভাবে তার বাচ্চা রাখার শুরু। সে হিসেবে শিশু রাখার কাজে তার প্রায় তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। নিজেরও তিনটি ছেলেমেয়ে। বড়ো ছেলেটি বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে। মেয়ে দুজনের এখনও বিয়ে হয়নি। তারা চাকরি করে এলাকারই পোশাক কারখানায়। নিজের সন্তান মানুষ করার পাশাপাশি অন্যের সন্তান দেখাশোনার কাজটা কষ্টকর হলেও শিশুদের সঙ্গ উপভোগ করেন সখিনা বেগম।

বছর বিশেক আগে তারা গাজীপুরার এই এলাকায় চলে আসেন। ইতিমধ্যে তার স্বামী আবার বিয়ে করেছেন। সংসারে অভাব আরো তীব্র হয়েছে। সখিনার উপার্জনটা তাই অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

সম্প্রতি ব্র্যাকের ইনস্টিটিউট এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট (বিআইইডি) থেকে শিল্পাঞ্চলে গড়ে ওঠা এমন অনানুষ্ঠানিক দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলোর মান উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একাজে বিআইইডিকে সহায়তা করছে ব্র্যাকের নগর উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউডিপি)। এজন্য সখিনা বেগমদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের ঘরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, চলমান করোনা মহামারির জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন এবং শিশুদের থাকার ঘরটি আকর্ষণীয় করার জন্য রং ও নকশা করতে দশ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত টঙ্গীতে ১১ জন ও গাজীপুরে ৬ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদেরই একজন সখিনা বেগম। পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালিত বিআইইডি-র এই উদ্যোগটি সাভারেও শুরু হতে যাচ্ছে।

সখিনার দিবাযত্ন কেন্দ্রে এখন পাঁচ জন শিশু থাকে। এদের বয়স দেড় থেকে চার বছর। মায়েরা অনেক সময় খাবার দিয়ে যান। কখনও সখিনার সংসারে যা রান্না হয় সেখান থেকেই খাইয়ে দেন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমের সময়। তখন তাদের কারো কারো জায়গা হয় ভেতরে সখিনাদের থাকার ঘরের খাটে। বিকেল হলে উঠোনে খেলাধুলোর সময়। তাদের খেলার জন্যই বিআইইডি-র পরামর্শ অনুযায়ী বাঁশের খেলনা কাঠামোটি বানানো হয়েছে। এমন বারোয়ারি উঠোনের সুবিধা হচ্ছে অন্য বাড়ির শিশুদের সঙ্গে হাসিখেলায় বড়ো হওয়ার সুযোগ।

উৎসাহী শিক্ষার্থী তিনি। আশেপাশের ছেলেমেয়ে আর ব্র্যাকের কর্মীদের সহায়তায় বাংলা বর্ণমালা ও সংখ্যা শিখে নিয়েছেন। ছড়া কবিতাও কণ্ঠস্থ করেছেন। শিশুরা শিখছে তার কাছে। “আপাগো থাইকা শিখা হাতের ছাপ দিয়া এডি আমি করছি।“ মেঝেয় রঙিন হাতের ছাপ দিয়ে করা নকশা দেখিয়ে বলেন।

একই উঠোনে পরিচয় হলো আদুরি বেগমের সঙ্গে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে আদুরি অভাবে পড়ে ঢাকায় এসেছেন বছর দশেক হলো। স্বামী সেলুন দোকানের কর্মী। অভাবে চার ছেলের তিনটিকেই পড়াতে পারেননি। এই বস্তিতে তারও শিশুদের দেখভালের কেন্দ্র রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে তার আয়ও যোগ হয়েছে।

এই এলাকার আরো অনেক নারী এ ধরনের দিবাযত্ন কেন্দ্র চালান বলে জানালেন উদ্যোগ-সংশ্লিষ্ট ব্র্যাকের কর্মসূচি সংগঠক খন্দকার সুরাইয়া মাহমুদ। শুরুতে নানা আশঙ্কায় দূরে থাকলেও সখিনা ও আদুরিদের কেন্দ্রের আয়-উন্নতি দেখে তারাও প্রশিক্ষণের জন্য এগিয়ে আসছেন।

“এই উদ্যোক্তাদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব কম। প্রশিক্ষণের সময় তাদের অক্ষর ও সংখ্যাজ্ঞান দিতে চেষ্টা করি যাতে তারা শিশুদের প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা প্রদানে সহায়তা করতে পারেন,“ জানান সুরাইয়া।

এই শিল্প এলাকায় ব্র্যাকের নগর উন্নয়ন কর্মসূচির একটি প্রাতিষ্ঠানিক দিবাযত্ন কেন্দ্রও রয়েছে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য ইউডিপি পরিচালিত ওয়ান-স্টপ সমন্বিত সেবাকেন্দ্রর অংশ। এখানেও শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের উপযোগী করে তুলতে বিআইইডি-র কারিগরি সহায়তা নেওয়া হয়েছে।

“বাড়িভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়তে ব্যাবসা পরিচালনা করার মানসিকতা প্রয়োজন,” বললেন সুরাইয়া মাহমুদ। তাই যারা আগে থেকেই এ ধরনের ব্যবসা করছেন তাদের উদ্যোগগুলোকেই যাতে আরো মানসম্পন্ন করা যায় বিআইইডি সেই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে ব্র্যাকের একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় তারা প্রশিক্ষণ ছাড়াও মাসে একবার রিফ্রেশারে অংশ নিতে পারেন। সেখানে হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন উপকরণ দিয়ে নিরাপদ খেলনা তৈরি, সেবার মান বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রাহক বাড়ানো, ব্যয়সাশ্রয়সহ বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে আরো শিখতে পারেন।

দেশে শ্রমজীবী পরিবারগুলোতে দিবাযত্ন কেন্দ্রের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ব্যয়সাশ্রয়ী ও বাড়ির কাছে হওয়ায় গৃহভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চাহিদাও তাই বাড়ছে। এসব উদ্যোগ যাতে মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিতে কাজ করছে ব্র্যাক এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়। ভবিষ্যতের সখিনা-আদুরিদের হাতে আরো অনেক মানসম্পন্ন দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠবে সেই প্রত্যাশা ও শুভকামনা আমাদের সকলের।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments